প্রায় চার দশকের সাজানো বাগান শুকিয়ে গিয়েছে এক ধাক্কায়। আড়াই বছর আগের বিধানসভা নির্বাচনেই তার ইঙ্গিত মিলেছিল। এ বার পঞ্চায়েত ভোটে বাঁকুড়ার গ্রামাঞ্চলও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আর এমন ভাবে ফিরিয়েছে যে, রাতারাতি তাঁদের ঘুরে দাঁড়ানোটা অসম্ভবআড়ালে মানছেন জেলা সিপিএম তথা বাম নেতৃত্ব।
কী করে এমন হল! বাঁকুড়া শহরে স্কুলডাঙায় সিপিএমের জেলা অফিসে কান পাতলে এই একটা কথাই বারবার শোনা যাচ্ছে। সিপিএমের তাবড় নেতা থেকে সাধারণ কর্মী, সকলের মনেই এই প্রশ্ন। জয়ের আশা তাঁরা কেউই করেননি। কিন্তু, তা বলে এমন দুরমুশ করে তাঁদের হারাবে তৃণমূল, সেটাও তাঁরা ভাবেননি! জেলা পরিষদের মোট ৪৬টি আসনের মধ্যে বামেদের ঝুলিতে গিয়েছে মাত্র ৫টি। আর জেলার মোট ১৯০টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ৩১টি এবং ২২টি পঞ্চায়েত সমিতির মধ্যে একটি পেয়েছে বামেরা। এমনকী, বাঁকুড়ার যে জঙ্গলমহল আড়াই বছর আগের সেই পরিবর্তনের সুনামিতেও বামেদের পাশে থেকেছে, সেখানেও এ বার মুখ থুবড়ে পড়েছে তারা।
তাঁদের সংগঠন দুর্বল হয়েছে এবং এই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে যে সময় লাগবে, তা এক কথায় মেনে নিচ্ছেন সিপিএমের বাঁকুড়া জেলা সম্পাদক তথা দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অমিয় পাত্র। তিনি বলেন, “সংগঠন দুর্বল হয়েছে। তার মেরামতিও দরকার। তবে, এক দিনে সংগঠন দুর্বল হয়নি। আবার এক দিনে ঠিকও হবে না। আমরা হারের কারণ পর্যালোচনা করে দেখব।”
বিপর্যয়ের ধাক্কায় বেসামাল বাম শিবিরে যেখানে চূড়ান্ত হতাশা, সেখানে তৃণমূল শিবির এমন জয়ে দৃশ্যতই উজ্জীবিত। বাঁকুড়ার মতো ‘লালদুর্গে’ যে কখনও তাঁরা জেলা পরিষদ গড়তে পারবেন, তা-ও একক ক্ষমতায়, কয়েক বছর আগে পর্যন্ত তা ছিল জেলা তৃণমূল নেতাদের কাছে অলীক স্বপ্ন। অথচ এ বার সেটাই বাস্তব হতে চলেছে। দীর্ঘ বাম জামানার অবসানের পরে এ বার নতুন হাতে জেলার অগ্রগতি কতটা হবে, তা নিয়েই চর্চায় ব্যস্ত সাধারণ মানুষ। কে হবেন জেলা পরিষদের সভাধিপতি, তা নিয়েও গ্রামেগঞ্জে, হাটে-বাজারে এখন জোর আলোচনা। দলের নিচুতুলাতেও জল্পনা তুঙ্গে। গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে দীর্ণ এই জেলায় তৃণমূলের একাধিক গোষ্ঠী থেকে সভাধিপতি হিসাবে একাধিক নাম উঠে আসছে। যদিও কোনও বিতর্কেই যেতে নারাজ দলের জেলা নেতারা। রাজ্যের শিশুকল্যাণ মন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় থেকে জেলা তৃণমূল সভাপতি অরূপ খাঁ, সম্ভাব্য সভাধিপতির প্রশ্নে সবার একটাই উত্তর, “দল জানে!”
পঞ্চায়েত নির্বাচনে এমন বিপর্যয়ের একাধিক ব্যাখ্যা মিলছে জেলা সিপিএম নেতাদের কাছে। তাঁদের একাংশের দাবি, গত পাঁচ বছরে পঞ্চায়েতগুলি ভাল কাজ করেনি। তারই খেসারত গুনতে হয়েছে এ বার। অন্য অংশের বক্তব্য, “রাজ্যে ক্ষমতা হারানোর পরে নেতারা গ্রামেগঞ্জে যাওয়াটাই ছেড়ে দিয়েছেন। জনসংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়াতেই মানুষের মন থেকে সরে গিয়েছি আমরা।” সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর এক নেতার ক্ষোভ, “সংগঠন একেবারেই ভেঙে পড়েছে। নিচুতলার নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের অভাব ছিল। ভোটের প্রচারে তাই তাঁরা কার্যত বাড়ি থেকেই বের হলেন না। সংগঠনের শক্তি না বাড়াতে পারলে আমাদের ভবিষ্যৎ আরও খারাপ হবে।”
অথচ ঘটনা হল, ভোটের অনেক আগেই জেলায় বাম ঐক্য তৈরি হয়েছিল। বিষ্ণুপুর মহকুমা বাদে বাকি দু’টি মহকুমাতেই (বাঁকুড়া সদর ও খাতড়া) প্রার্থী দিয়ে লড়াই করেছে সিপিএম। জঙ্গলমহলের চারটি ব্লকে পঞ্চায়েতের ত্রিস্তরেই প্রায় প্রত্যেকটি আসনে লড়াই হয়েছে। এমনকী, এই লড়াইয়ে তৃণমূলের বিক্ষুদ্ধ গোষ্ঠীর একটা অংশকেও সঙ্গে পেয়েছিল বামফ্রন্ট। তার পরেও এমন হতাশাজনক ফলে বাম নেতাদের কাঁধ ঝুলে গিয়েছে। সিপিএমের জেলা কমিটির এক সদস্যের হতাশা, “রাইপুর, সিমলাপাল, সারেঙ্গা ও রানিবাঁধ ব্লকে আমরা পঞ্চায়েত সমিতি পাব বলে নিশ্চিত ছিলাম। সেখানে সিমলাপাল ব্লকের তিনটি, সারেঙ্গা ও রাইপুর ব্লকে একটি করে গ্রাম পঞ্চায়েত ছাড়া কিছু পেলাম না।”
জঙ্গলমহলে খারাপ ফলের জন্য মূলত বাম আমলের অনুন্নয়নকেই দায়ী করছেন সেখানকার সাধারণ মানুষের একটা বড় অংশ। তাঁরা বলছেন, “বাম আমলে গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতিগুলি দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছিল। সার্বিক ভাবে ব্লক বা পঞ্চায়েত স্তরে উন্নয়ন হয়নি। পানীয় জল, রাস্তাঘাট, বিদ্যুদয়নের মতো মৌলিক সমস্যা দীর্ঘদিন পরেও মেটেনি।” জঙ্গলমহলের বাম নেতারাও মানছেন, “বিশেষ করে বিধানসভা ভোটের পরে পঞ্চায়েতগুলিতে কাজকর্ম হত না বললেই চলে, যার জেরে ক্ষোভ দানা বাঁধছিল। আর সেই ক্ষোভই প্রতিফলিত ভোটের বাক্সে।”
সিমলাপাল গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার এক বাসিন্দার কথায়, “এলাকায় বিগত দিনে উল্লেখযোগ্য কোনও কাজই হয়নি। অথচ এখানে রাস্তা বা জলের সমস্যা দীর্ঘদিনের। সিমলাপাল পঞ্চায়েত সমিতি ও সমস্ত পঞ্চায়েত বামেদেরই দখলে ছিল দীর্ঘদিন ধরে। পরিবর্তন হলে যদি কিছু হয়, তাই উল্টো দিকে ভোট দিলাম।” সারেঙ্গার চিলতোড় পঞ্চায়েতের একাধিক বাসিন্দা সাফ বললেন,“বামেদের দখলে থাকা সারেঙ্গা পঞ্চায়েত সমিতি বা পঞ্চায়েতের তরফ থেকে ভাল কাজ হয়নি। সমস্যার কথা বারবার জানিয়েও কাজ হয়নি। তাই এ বার বামফ্রন্টকে ভোট দিইনি!”
তৃণমূল রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পরে যে বড় কোনও পরিবর্তন হয়েছে, এমনটাও বলছেন না জঙ্গলমহলের মানুষ। বরং তাঁদের কথায়, “বিধানসভা ভোটের আগে বারবার বলা হয়েছিল তৃণমূল জিতলে গ্রামের ঘরে ঘরে পানীয় জল দেবে। রাস্তা বানাবে। বামেরা কিছুই করেনি। তাই এ বার ওদেরই (তৃণমূল) ভোটটা দিলাম, দেখি কী হয়। তা ছাড়া, সরকারে যে দল ক্ষমতায়, তারাই পঞ্চায়েত স্তরে ক্ষমতায় এলে হয়তো কাজের কাজ কিছু হবে।” আপাতদৃষ্টিতে রাজনৈতিক সন্ত্রাস মুক্ত বাঁকুড়ার জঙ্গলমহলেও সিপিএম প্রচারে গা লাগায়নি। এটাও তাদের মুখ থুবড়ে পড়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন এখানকার বাসিন্দারা। রাইপুর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার বাসিন্দাদের একাংশের কথায়, “সিপিএম তো ধুঁকছে! আগে যখন ওরা ক্ষমতায় ছিল, তখনই কিছু করল না। এখন তো ওদের দেখতেই পাই না। প্রচারও করেনি সে ভাবে। ভাল হবেটা কোত্থেকে?” জেলা তৃণমূল সভাপতির দাবি, “জঙ্গলমহলে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে ঢালাও উন্নয়ন হয়েছে। মানুষ তাই আমাদের ঢেলে ভোট দিয়েছেন।”
সিপিএমের সারেঙ্গা জোনাল কমিটির সম্পাদক অজিত চট্টোপাধ্যায় বলেন, “গ্রাম পঞ্চায়েত বা পঞ্চায়েত সমিতির কাজের জন্য কিছু মানুষের মনে ক্ষোভ হয়তো জমেছিল। তার প্রভাব ভোটের ফলে পড়ে থাকতেও পারে। তবে প্রাথমিকভাবে যা বুঝেছি, আমাদের হারার মূল কারণ, তৃণমূল যে হারে পয়সা ছড়িয়েছে তাতেই মানুষের মন বদলে গিয়েছে। যারা আমাদের হয়ে বাড়িবাড়ি প্রচারে যাচ্ছিল, ভোটের আগের দিন থেকে তারাই আমাদের ছেড়ে তৃণমূল শিবিরে ঢুকে পড়ল।” টাকা ছড়ানোর অভিযোগ অস্বীকার করে তৃণমূলের এক নেতার টিপ্পনী, “তা হলে সিপিএম মেনে নিচ্ছে, ঘরের লোককেই ওরা সামলাতে ব্যর্থ! সেখানে এত ভোটারদের মন কী করে বুঝবে? ফল যা হওয়ার তাই-ই হয়েছে।” |