দীর্ঘ ৩৫ বছর।
সেই ১৯৭৮ সাল থেকে টানা শাসন করার পরে এ বার পুরুলিয়া জেলা পরিষদ হাতছাড়া হল বামেদের। শুধু হাতছাড়াই নয়, বিরোধী দলের মর্যাদাও খোয়াতে হল। জেলা পরিষদের ৩৮টি আসনের মধ্যে ৩১টি আসন দখল করে জেলা পরিষদ দখল করল তৃণমূল। চারটি আসন পেয়ে বিরোধী দলের স্বীকৃতি পেল কংগ্রেস। আর সিপিএম পেল মোটে ৩টি আসন।
পাঁচ বছর অন্তর নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে এখানে জেলা পরিষদ ধরে রাখছিল বামফ্রন্ট। যে ২০০৮ সালের ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত নির্বাচনে রাজ্যজুড়ে প্রথম পরিবর্তনের সঙ্কেত দেখা দিয়েছিল, সে বারও এই জেলায় ৩৫টি (তখন জেলা পরিষদের আসন ছিল ৩৫) আসনের মধ্যে বামফ্রন্ট পেয়েছিল ৩০টি। আর তৃণমূল শূন্য। ২০১১-তে রাজ্য সরকারের পরিবর্তনের পরে এ বার যে জেলা পরিষদে বামেদের বিপর্যয় ঘটবে তা অনেকটা প্রত্যাশিত ছিলই। তবে এই জেলায় কংগ্রেসেরও প্রভাব মন্দ নয়। কিছু ক্ষেত্রে বাম বিরোধী ওই দুই দলের ভোট কাটাকাটির সুফল তাঁদের পক্ষে যাবে বলে বাম নেতৃত্ব আশা করেছিলেন। সেই সঙ্গে লড়াইয়ের ময়দানে নামা তৃণমূলের গোঁজ প্রার্থীরা সেই সম্ভবনা কিছুটা বাড়িয়ে দিয়েছিল। সিপিএমের এক জেলা নেতার কথায়, “একক ভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আমরা না পেলেও ত্রিশঙ্কু হবে বলে ভেবেছিলাম।”
কিন্তু বাস্তবে তা হল না। বান্দোয়ান, বরাবাজার, আড়শা, মানবাজার ১, মানবাজার ২, রঘুনাথপুর ২, পাড়া, পুঞ্চা-সহ জেলার যে সমস্ত এলাকাগুলি দীর্ঘদিন ধরে বামেদেরই দুর্গ বলে এতদিন পরিচিত ছিল, সেই সব এলাকা থেকেই বামফ্রন্ট প্রায় মুছে গিয়েছে। বামফ্রন্ট তিনটি আসন পেয়েছে রঘুনাথপুর ২, পাড়া ও ঝালদা ২ ব্লক এলাকা থেকে। রাজনীতির কারবারিদের মতে, বাম বিরোধী ভোটের একটা বড় অংশ কংগ্রেস কেটে নেওয়ায় শিঁকে ছিড়েছে ওই তিন বাম প্রার্থীর। তা না হলে হয়তো জেলা পরিষদে বামফ্রন্টকে খালি হাতেই এ বার ভোটের ময়দান থেকে ফিরতে হত।
নিতুড়িয়া, সাঁতুড়ি, রঘুনাথপুর ১, কাশীপুর, হুড়া, পুঞ্চা, মানবাজার ১ ও ২, বান্দোয়ান, বরাবাজার, বলরামপুর, পুরুলিয়া ১, পুরুলিয়া ২, আড়শা, জয়পুর ব্লকের সমস্ত আসনই গিয়েছে তৃণমূলের দখলে। অন্য ব্লকগুলির মধ্যে গত বিধানসভা ভোটে বামেদের দখলে থাকা ঝালদা ২ ও কংগ্রসের দখলে থাকা পাড়া বিধানসভা এলাকাতেও খাতা খুলেছে তৃণমূল। এই দুই ব্লকের চারটি আসনের মধ্যে দু’টিতে জয়ী হয়েছে তৃণমূল।
এ বার ৩৮ জনের মধ্যে ৩৭ জন নতুন মুখ এনে, বামফ্রন্টে সার্বিক ঐক্য হওয়ার পরেও এই ফল কেন? সিপিএমের জেলা সম্পাদক মণীন্দ্র গোপ বলেন, “এ বার যে এমন ফল হবে, আমরা আগে বুঝতে পারিনি। এর কারণ খতিয়ে দেখা হবে।” এখই সঙ্গে তাঁর অভিযোগ, টাকা ছড়িয়ে ও প্রশাসনকে ব্যবহার করেছে তৃণমূল। তবে বামফ্রন্টের একাংশের ব্যাখ্যা, নতুন মুখেদের প্রার্থী করা হলেও প্রচারে সামনের সারিতে ছিলেন সেই পুরনো মুখেরাই। যাঁদের দিক থেকে বিধানসভা ভোটেই মানুষ মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলেন। ভোটারদের অনেকেই জানিয়েছেন, বামফ্রন্ট টানা থেকে কী করল? এই জেলায় পানীয় জল ও সেচের জলের সমস্যা সেই তিমিরেই রয়ে গিয়েছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার হালই বা কতটা ফিরেছে! উল্টে চোখের সামনে বামপন্থী নেতা-কর্মীদের আখের গোছাতে দেখা গিয়েছে। বাম মনোভাবাপন্ন মানুষরাও বলছেন, “দলে তো পরিবারতন্ত্র শুরু হয়ে গিয়েছিল। তাই একটা ধাক্কা দেওয়ার দরকার ছিল।” সিপিএমের জেলা সম্পাদক মণ্ডলীর বর্ষীয়ান সদস্য দীনবন্ধু বন্দ্যোপাধ্যায় স্বীকার করেন, “আমলাতান্ত্রিক মানসিকতা কাটিয়ে না উঠতে পারায় সাধারণ মানুষ ও দলের কর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব ঘোচেনি। তাই এই ফল।”
জেলা তৃণমূল সভাপতি শান্তিরাম মাহাতো বলছেন, “বামফ্রন্টের অপশাসনে বিরক্ত মানুষ আমাদের দায়িত্ব বাড়িয়েছেন। পানীয় জল ও সেচ ব্যবস্থার উন্নয়নে জোর দেব।” |