তিন বছরেরও বেশি সময় রেল মন্ত্রক ছিল তৃণমূলের হাতে। কেন্দ্রীয় সরকার ছেড়ে তৃণমূল বেরিয়ে আসার পরে রেলের প্রথম নির্বাচনে বাংলার তিন জোনেই ধাক্কা খেতে হল তৃণমূল প্রভাবিত কর্মচারী সংগঠনকে। স্মরণযোগ্য কালের মধ্যে এই প্রথম বার মেট্রো রেলে মদন মিত্রদের ইউনিয়ন পর্যুদস্ত হল। দক্ষিণ-পূর্ব রেলে অল্পের জন্য রক্ষা পেল তৃণমূল প্রভাবিত সংগঠনের জামানত। লোকসভা এবং পঞ্চায়েত ভোটের আগে রেলের ভোটের এই ফলকে ইঙ্গিতবাহী বলেই মনে করছে বাম ও কংগ্রেস। সারা দেশের রেলওয়ে জোনেই যাদের ফল ভাল হয়েছে।
গোটা দেশে রেলের মোট ১৭টি জোন। তার মধ্যে এ রাজ্যে তিনটি (মেট্রোও এখন পৃথক জোনের পর্যায়ভুক্ত)। গত ২৫, ২৬ ও ২৭ এপ্রিল সব জোনে কর্মচারীদের যে ভোট হয়েছিল, তার যে ফলাফল বৃহস্পতিবার সামনে এসেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে: বাম মনোভাবাপন্ন সংগঠন এআইএফএস ১৬টি জোনেই ৩০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে প্রতিনিধিত্বকারী ইউনিয়নের মর্যাদা পেয়েছে। কংগ্রেস প্রভাবিত এনএফআইআর একই ভাবে ওই মর্যাদা পেয়েছে ১২টিতে। সারা দেশে ইউনিয়নগুলির ভারসাম্যের সামগ্রিক ছবিটা আগে মোটামুটি এই রকমই ছিল। কিন্তু গত লোকসভা নির্বাচনের পরে এ রাজ্যের রেলে তৃণমূলের প্রভাবের প্রেক্ষিতে তিন জোনেই তাদের তৃতীয় স্থানে শেষ করাকে ইঙ্গিতপূর্ণ বলে ধরছে বিরোধীরা। তৃণমূল এ বারের নির্বাচনে অংশগ্রহণকেই ভবিষ্যতে সংগঠন বাড়ানোর লক্ষ্যে এক ধাপ বলে মনে করছে। তাদের মেট্রো ইউনিয়নের নেতা মদনবাবুর সরাসরি অভিযোগ, সিপিএম-কংগ্রেসের ইউনিয়নের সঙ্গে রেল কর্তৃপক্ষও তাঁদের বিরুদ্ধে ‘চক্রান্তে’ সামিল হয়েছিলেন।
রেলের কর্মচারীদের ভোট কোনও ভাবেই সাধারণ নির্বাচন নয়। তবে স্কুলের পরিচালন কমিটির নির্বাচনের মতো এই ধরনের ভোটেও সংশ্লিষ্ট জনতার মনোভাবের একটি খণ্ডিত চিত্র ধরা পড়ে বলে রাজনৈতিক শিবিরের ব্যাখ্যা। যে কারণে এ বারের রেল-ভোটের পরে রেল প্রতিমন্ত্রী তথা কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরী বলেছেন, “এটাই প্রমাণ করে, তৃণমূল ঠিকমতো রেল পরিচালনা করতে পারেনি। পারলে ভোটের ফল অন্য কথা বলত। রেলকর্মীরা মন থেকে সরিয়ে দিয়েছেন বলে সমূলে উৎপাটিত হয়েছে তৃণমূল! রাজ্যের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। পঞ্চায়েতেই তা প্রমাণিত হবে!” একই সুরে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মহম্মদ সেলিমের দাবি, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে দু’বছর এবং তাঁর দলের নেতারা আরও দেড় বছর রেলমন্ত্রী ছিলেন। রেলকে ওঁরা রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহার করতেন। রেলের মাধ্যমে বিপুল উন্নয়নের কাজ করেছেন বলে দাবি করতেন। এখন দেখা যাচ্ছে, রেলের কর্মীরা ওঁদের কাজকর্ম মেনে নেননি! রাজ্যের ক্ষেত্রেও মানুষের একই মনোভাব ভবিষ্যতে দেখা যাবে!” সম্প্রতি বিএসএনএলের কর্মচারী নির্বাচনেও বড় সাফল্য পেয়েছিল বামপন্থী ইউনিয়ন। অধীরবাবুর আরও বক্তব্য, “আমরা গোলমালের আশঙ্কায় আরপিএফ প্রহরা বাড়িয়েছিলাম। যাতে কর্মীরা সবাই ঠিকমতো ভোট দিতে পারেন। ভোট সবাই দিয়েছেন বলে ফলও পরিষ্কার!”
রেল মন্ত্রক তৃণমূলের হাতে থাকার সুবাদে গত সাড়ে তিন বছরে কলকাতা মেট্রোয় অনেকটাই ক্ষমতা দখল করেছিল তৃণমূল প্রভাবিত ‘ইস্টার্ন রেলওয়ে এমপ্লয়িজ ওয়ার্কাস কংগ্রেস’ (ইআরইডব্লিউসি)। তাঁদের সময়েই মেট্রোকে আলাদা জোন ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এই প্রথম মেট্রো রেলের ভোটে পৃথক লড়াইয়ে ইআরইডব্লিউসি ইউনিয়নের মান্যতাই পেল না!
মেট্রো রেলে বাম প্রভাবিত মেন্স ইউনিয়ন মোট তিন হাজার ভোটের মধ্যে পেয়েছে ১৪০০টি। কংগ্রেস প্রভাবিত মেন্স কংগ্রেস ৮০০টি। খাস কলকাতাতেই তৃণমূলের প্রভাবিত ইআরইডব্লিউসি তৃতীয় স্থানে রয়েছে ৭০০টি ভোট পেয়ে। দীর্ঘ দিন ধরেই এই ইউনিয়নের দায়িত্বে পরিবহণমন্ত্রী মদনবাবু। আছেন তৃণমূল নেত্রীর ভাই কার্তিক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তৃণমূল বিধায়ক তমোনাশ ঘোষও। যে কারণে সেলিমের কটাক্ষ, “বামেদের সময় থেকেই দেখেছি মেট্রোর ইউনিয়নে আছেন মদন মিত্রেরা। রেল মন্ত্রক হাতে থাকার সময় মেট্রো রেলকে নিয়ে মমতা ও তাঁর দল যা খুশি করেছেন। তাতে কর্মীদের কী মনোভাব, এখন বোঝা গেল!”
মদনবাবুর দাবি, “সিপিএম এবং কংগ্রেসের সংগঠন থেকে রটানো হয়েছিল, জিতলেও তৃণমূল সংগঠন ক্ষমতা দখল করতে পারবে না। কারণ, ১৭টা জোনের মধ্যে তৃণমূলের সংগঠন তিনটিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। কংগ্রেস-সিপিএমের ইউনিয়নের সঙ্গে সর্বভারতীয় রেল কর্তৃপক্ষও আমাদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করেছেন।” মদনবাবুর আরও দাবি, তাঁদের ফল খুব খারাপ হয়নি। বরং এই নির্বাচনে অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়েই সংগঠনকে আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রতিষ্ঠা করা গেল। তমোনাশবাবুর বক্তব্য, “এটা যে আমাদের লড়াই, সময়মতো দল থেকে সেই বার্তাটা যায়নি। ফলে, কর্মীদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমর্থকেরা যাঁরা এত দিন কংগ্রেস ইউনিয়নের সঙ্গে ছিলেন, তাঁরা বেরিয়ে এসে তৃণমূল সংগঠনকে সহযোগিতা করেননি।”
পূর্ব রেলের প্রতিটি ডিভিশনেও তৃণমূলের হাল খারাপ। পূর্ব রেলের মোট ভোটার ছিলেন ১ লক্ষ ৮২ হাজার ৮৫৯। ভোট পড়েছে ৯২ হাজার ৯৪৫টি। সদর দফতর-সহ বিভিন্ন ডিভিশনে তৃণমূল যে সুবিধা করতে পারেনি, প্রাপ্ত ভোট দেখলেই পরিষ্কার। ইস্টার্ন রেল মেন্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সন্তোষকুমার ব্রহ্মের কথায়, “মেট্রো, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব রেলে আমরা আছি। কর্মীরা বুঝেছেন, আমরা ছাড়া তাঁদের স্বার্থ কেউ দেখবে না!”
পূর্ব রেলের সদর দফতরের বাম প্রভাবিত ইউনিয়ন পেয়েছে ৩ হাজার ৪১৮টি ভোট। তৃণমূল প্রভাবিত ইউনিয়ন পেয়েছে ৯১৮টি ভোট। আর কংগ্রেস প্রভাবিত ইউনিয়নের ঝুলিতে এসেছে ২২৯৭টি ভোট। প্রাক্তন রেলমন্ত্রী মুকুল রায়ের খাস তালুক কাঁচরাপাড়া ওয়ার্কশপে বাম সংগঠন পেয়েছে ২৯৪০টি ভোট। কংগ্রেস প্রভাবিত সংগঠন ২৯০৯ এবং তৃণমূল প্রভাবিত সংগঠন ২৪৭৭টি ভোট পেয়েছে। জামালপুর, মালদহ, আসানসোল, লিলুয়ায় তৃণমূল প্রভাবিত ইউনিয়নের অবস্থা প্রায় ভেঙে পড়ার মতো!
যে জঙ্গলমহলে মমতা ‘হাসি’ ফুটিয়েছেন বলে থাকেন, সেই দক্ষিণ-পূর্ব রেলের আদ্রা ডিভিশনেও হেরেছে তৃণমূল প্রভাবিত ইউনিয়ন! এখানে এক নম্বরে কংগ্রেস প্রভাবিত ইউনিয়ন। তারা পেয়েছে ৬০৮৩টি ভোট। বাম প্রভাবিত ইউনিয়ন পেয়েছে ৪৫২৪টি এবং তৃণমূলের সংগঠন পেয়েছে মাত্র ৪১৯টি ভোট। রাঁচি, দক্ষিণ-পূর্ব রেলের সদর দফতর, খড়্গপুর, খড়্গপুর ওয়ার্কশপ ও চক্রধরপুর ডিভিশনেও একই হাল তৃণমূলের। এই রেলে যৌথ ভাবে মান্যতা পেয়েছে কংগ্রেস প্রভাবিত মেন্স কংগ্রেস ও বাম প্রভাবিত মেন্স ইউনিয়ন। দক্ষিণ-পূর্ব রেলের মেন্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জগন্নাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া, “আমরা খুশি। তৃণমূলের কোনও ক্রমে জামানত বেঁচেছে!”
|