ইউএস ওপেনে একে বলে সুপার স্যাটারডে। চ্যাম্পিয়নশিপের শেষ শনিবারের সেই টিকিটের জন্য মাদকতাও থাকে সবচেয়ে বেশি। কারণ, এক টিকিটে দেখার সুযোগ থাকে পুরুষদের দুটো সেমিফাইনাল। মেয়েদের ফাইনাল। মোহালি যে টেস্ট ক্রিকেট অনুপাতে এ দিন বেশ ভিড়-টিড় করে স্টেডিয়ামে হাজির হয়েছিল তার পিছনেও সুপার সানডে দেখার অপ্রত্যাশিত সুযোগ। তিনটে সম্ভাবনা যে একই দিনে, এক টিকিটের দামে দেখার সুযোগ খুলে যেতে পারে!
শিখর ধবনের ডাবল সেঞ্চুরি।
সচিন তেন্ডুলকরের বড় রান।
ভারতের জেতার সম্ভাবনা তৈরি হতে দেখা।
সকালের চড়চড়ে রোদের মধ্যে খুব দ্রুত অস্ত গেল প্রথম সম্ভাবনাটা। প্রেসবক্সে ঠিক পাশে বসা পঞ্জাবি স্কোরার তাঁর সহকারীকে বেশ উত্তেজিত ভাবে বললেন, “উমিদদা তে খারে নেহি উতরে ধবন!” মানে কী? ব্যাটে লাগেনি? প্যাডে লেগে ফরোয়ার্ড শর্ট লেগ ফিল্ডারের হাতে গেল? হতেও পারে! ডাবল সেঞ্চুরি থেকে ১৩ রান অসমাপ্ত রেখে প্যাভিলিয়নের দিকে ফেরার সময় ক্লোজ ইন ফিল্ডারের সঙ্গে তাঁর একটা আদানপ্রদানও তো দেখা গেল।
বয়স্ক পঞ্জাবি মাথা নাড়ালেন, “তা নয়। ওকে বললাম ধবনটা স্রেফ ঝোলাল। কী ভেবেছিলাম আর কী ঘটল।”
জনতাকে তখনও বিপন্ন দেখাচ্ছে না। প্রেসবক্সের ঠিক নীচে যে ভিড়টার কাছে টিভি ক্যামেরাম্যান বারবার ঘুরে আসছেন, তারা ততক্ষণে ব্যানার লাগিয়েই ফেলেছেন‘সচিন আমাদের জীবন থেকে তোমাকে কুড়ি বছর দিয়ে দিচ্ছি, এখনই ক্রিকেট ছেড়ে দিও না।’ বোঝা গেল, পাবলিক চাইছে দ্বিতীয় উইকেটটা খসুক। একটা জঘন্য এলবিডব্লিউ-র সিদ্ধান্তে পূজারা যে আউটও হয়ে গেলেন তাতে মনে হল না কাউকে কাতর দেখাচ্ছে বলে। |
ব্রাউনওয়াশের দিকে। স্মিথ বোল্ড ভুবনেশ্বর। ছবি: উৎপল সরকার |
মোহালি পিচের বরাবর ফেভারিট। ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি এখানে রান করা। এখানেই লারার মোট টেস্ট রানের বিশ্বরেকর্ড ভেঙে দেওয়া মানুষ যদি আজ রোববারের বাজারে বিদায়ী সেঞ্চুরি করে দেন, কে মনে রাখবে শিখর ধবনকে? আন্ডারডগ ফিরে যাবে নিজভূমিতে। গ্ল্যামারাস মহানায়ক অটল থেকে যাবেন তাঁর সিংহাসনে! খেলার প্যাটার্ন দেখে হয়তো আগেই আন্দাজ করা উচিত ছিল। কেউ বোঝেনি এটা প্রথম বল থেকেই আন্ডারডগদের টেস্ট ম্যাচ হিসেবে শুরু হয়েছে। আর সেই থিম সংটাই আগাগোড়া বাজবে। প্রথম দিন জাডেজা। তার পর ধবন। মুরলী। আজ ভুবনেশ। পুরনো জমানার রক্তবমি শুরু হওয়ার সময় এঁরাই এক এক জন বোধহয় ধোনি রাজের নতুন দিশা।
যাক গে, সচিন শুরু করলেন দারুণ। একটা সময় তিনি ৩৪ বলে ২৭। ড্রাইভে তিনটে এমন বাউন্ডারি মেরে ফেলেছেন যার প্রত্যেকটার ছবি পেন্টিং হিসেবে বাড়িতে ঝুলিয়ে রাখা যায়। এর পরেই হঠাৎ হাওড়া ঢোকার মুখে রামরাজাতলায় কথা নেই বার্তা নেই ট্রেন যেমন ঘ্যাচাং করে দাঁড়িয়ে যায়, তেমনই নিষ্ক্রিয় হয়ে গেলেন। ‘হঠাৎ’ কথাটা বোধহয় ভুল লেখা হল। সামনে যে বাঁ-হাতি স্পিনার এসে গিয়েছে। ক্রিকেটজীবনের প্রৌঢ়ত্বে এসে তেন্ডুলকরের এই একটা রোগ দেখা দিয়েছে ন্যাটা স্পিনার। সে সামনে চলে এলেই তিনি কেমন ক্রিকেট ধনুর্বিদ্যা বিস্মৃত হয়ে পড়ছেন। বাঁ-হাতি স্পিনার এখন সচিনের জীবনে ততটাই বাধা, যতটা ভীষ্মের সামনে শিখণ্ডি।
ড্যানিয়েল ভেত্তোরিতে সমস্যা। মন্টি পানেসরে সমস্যা। তা বলে জেভিয়ার ডোহার্টিও সমস্যা করবেন কে ভেবেছিল? ডোহার্টি গোটা দিনে কাউকে অবাক না করেই উইকেটহীন থাকলেন। কিন্তু সচিনের বিরুদ্ধে আজকের স্পেলটা তো তাঁর সিডি-তে ডাউনলোড করে ব্যক্তিগত বিশেষ সংগ্রহে রেখে দেওয়ার মতো কাজ। রীতিমতো ছন্দে পৌঁছে যাওয়া তেন্ডুলকর তাঁর সামনে এমন ভাবে খেললেন যেন স্পিন খেলতে অনভিজ্ঞদের বিরুদ্ধে বাপু নাদকার্নির স্পেল চলছে! ডোহার্টির ২৯ বল থেকে সচিন পেলেন মাত্র ১ রান! হ্যাঁ, ছাপার ভুল নয়। ২৯ বল থেকে ১।
অফিশিয়াল টিভি প্রযোজকদের কাছে টেস্ট ম্যাচে রোববার সচিন মানে দুর্ধর্ষ লাইফলাইন। সাধারণ ভাবে টিআরপি-র হার হল টেস্টে শতকরা ২-৩। ওয়ান ডে-তে ৪-৫। আইপিএলে ৭-৮। সচিনের বড় ইনিংস মানে রোববারে অব্যর্থ ভাবে ওটা দুই শতাংশ থেকে উঠে গিয়ে ওয়ান ডে ছুঁইছুঁই টিআরপি-তে পৌঁছে যাবে। তা বলে এ দিনের ৮১ বলে ৩৭ তো টিআরপি যুদ্ধও জেতাতে পারবে না। এর মধ্যে পাঁচটা অনবদ্য বাউন্ডারি যদি সরিয়ে নেওয়া যায়, তা হলে ৭৬ বলে ১৭ রান। এমন সময়, যখন দু’উইকেটে সাড়ে তিনশোর খাটান দিচ্ছে অস্ট্রেলিয়া! যখন দ্রুত রান চাই যাতে সেই রানের সৌধের নীচে অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় ইনিংস মানসিক ভাবে চাপা পড়ে। ‘স্টার ক্রিকেট’ টিভি বক্সে দেখা গেল ভাষ্যকারদের মধ্যে উত্তপ্ত চর্চা চলছে সচিন-মুরলী পার্টনারশিপ এত মন্থর হয়ে পড়াই ম্যাচটাকে ড্রয়ের দিকে ঠেলে দিল কি না? টিম ইন্ডিয়া ড্রেসিংরুম থেকে এঁদের মধ্যে যিনি সবার পরে, সদ্য মাসছয়েক হল বেরিয়েছেন সেই ভিভিএস লক্ষ্মণ সমর্থন করলেন ব্যাটসম্যানদের, “নিশ্চয়ই ক্যাপ্টেন ব্যাট করে যেতে বলেছে। তা ছাড়া চালানোটা সহজ নয় আজ। ধবনকে দেখে ধরে নিয়েছেন যত ইজি, তত ইজি মোটেও নয়।”
তাঁর বিশ্লেষণও এই খচখচানিটা দূর করতে পারল না যে, আর একটু তাড়াতাড়ি রানটা তুললে দ্বিতীয় নতুন বলের সামনে এই ধসটা আবির্ভূতই হয় না! শিখর গতকাল ওভারপিছু ৫ রানের অ্যাক্সেলরেটরে চাপ রেখে যাওয়ার পর তথাকথিত সুপার সানডে-তে হল ওভারপিছু তিন রানেরও কম। ৭৫ ওভারে ২১৬। সবচেয়ে বড় কথা ক্যাপ্টেন তো আর ২৯ বলে ১ করতে বলেননি।
প্রাচীন অস্ট্রেলিয়া হলে এখানেই গল্প শেষ। ম্যাচে ফেরার একটা জায়গা দিয়েছ কী তারা একেবারে সিমেন্ট করে দিত! অবধারিত ড্র। আজকের অস্ট্রেলিয়ার সেই দম নেই। ওয়ার্নারের ধারাবাহিক রান না পাওয়া মিডল অর্ডারকে আরও চাপে ছুড়ে দিচ্ছে। চেন্নাইয়ের প্রথম ইনিংস বাদ দিলে তাঁর আউট হওয়ার স্ট্রোকগুলোও এমন যে, কেউ জিজ্ঞেস করতে পারে, এ প্রশ্নপত্র শুধু ঠিক সময়ে জমা দিয়েছে বলেই কি সাসপেন্ড হবে না? ভাবাই যায়নি দিনান্তে মাত্র ২১ ওভারও যে টেনশনহীন কাটাতে পারবে না ক্লার্কের টিম। ক্লার্ক পিঠের ব্যথায় কাতর থাকুন বা না, একমাত্র তাঁর উইকেটটা না পড়াই ভারতকে জয় সম্ভাবনার প্রত্যাবর্তনের মধ্যেও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত রাখবে। ভুবনেশ্বর কুমার অবশ্য বল চমৎকার সুইংও করিয়েছেন। ওয়েট ট্রেনিং করে চেহারাটা একটু শক্তপোক্ত গড়ে নিতে পারলে এই তরুণ ভারতীয় ক্রিকেটকে টানবেন। তাঁর সম্পর্কে রটছিল যে, নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসের বোলার। আবহাওয়া থেকে শীত-শীত ভাবটা চলে গেলে ভুবনেশ আর সুইং পান না। আন্ডারডগদের এ সব শুনতেই হয়। আবার আন্ডারডগরাই সাড়া ফেলে দেয় প্রচলিত হিসেবকে ভাঙচুর করে। যেমন ড্রয়ের সহজ পাটিগণিত বই উল্টে দিয়ে ৩-০ সম্ভাবনার আকাশ দেখাচ্ছেন ভুবনেশ। রাতে কপিল দেব বলছিলেন, “জাহিরের পর কোনও ভারতীয় বোলারকে আমি এত ভাল সুইং করাতে দেখিনি। দেখে দিল খুশ হয়ে গেল।” তবে সোমবার কপিলের ম্যাচ জেতানোর ঘোড়া ভুবনেশ্বর নন। রবিচন্দ্রন অশ্বিন।
ভারত এখনও ১৬ রানে এগিয়ে। ফেলতে হবে সাত উইকেট। আর হ্যাঁ, ফার্স্ট স্লিপে ক্যাচ নিতে হবে। স্পিনারের বলে ওখানে যেতেই পারে। রোববার ওই অভিশপ্ত জায়গাটায় কোহলিকে সরিয়ে নতুন অতিথি ছিলেন অশ্বিন। তা প্রথম ওভারেই তিনি সহজ ক্যাচ ছেড়েছেন। ফার্স্ট স্লিপ জায়গাটার একটু শান্তিস্বস্ত্যয়ন না হলে অমন যে লোভনীয় ৩-০, সেটাও না মুখের কাছে এসে আটকে যায়!
অং বং চং। অং বং চং। অং বং চং।
|
ভারত প্রথম ইনিংস ৪৯৯
(আগের দিন ২৮৩-০) |
বিজয় এলবিডব্লিউ স্টার্ক ১৫৩
শিখর ক কাওয়ান বো লিয়ঁ ১৮৭
পূজারা এলবিডব্লিউ সিডল ১
সচিন ক কাওয়ান বো স্মিথ ৩৭
বিরাট ন.আ. ৬৭
ধোনি এলবিডব্লিউ স্টার্ক ৪
জাডেজা ক হাডিন বো সিডল ৮
অশ্বিন ক হাডিন বো সিডল ৪
ভুবনেশ্বর ক হাডিন বো এনরিকে ১৮
ইশান্ত ক হাডিন বো সিডল ০
প্রজ্ঞান বো সিডল ১
অতিরিক্ত ১৯
মোট ৪৯৯।
পতন: ২৮৯, ২৯২, ৩৮৪, ৪১২, ৪১৬, ৪২৭, ৪৩১, ৪৯২, ৪৯৩।
বোলিং: স্টার্ক ২৩-৫-৭৪-২, সিডল ২৯.১-৯-৭১-৫, এনরিকে ১৫-১-৬২-১
লিয়ঁ ৩১-৪-১২৪-১, ডোহার্টি ২৪-৮-৮৭-০, স্মিথ ১০-০-৬৩-১।
|
অস্ট্রেলিয়া ৪০৮ ও ৭৫-৩ |
ওয়ার্নার ক ধোনি বো ভুবনেশ্বর ২
কাওয়ান এলবিডব্লিউ ভুবনেশ্বর ৮
হিউজ ব্যাটিং ৫৩
স্মিথ বো ভুবনেশ্বর ৫
লিয়ঁ ব্যাটিং ৪
অতিরিক্ত ৩
মোট ৭৫-৩।
পতন: ২, ৩৫, ৫৫।
বোলিং: ভুবনেশ্বর ৮-১-২৫-৩, ইশান্ত ২-০-১১-০, অশ্বিন ৭-২-২৫-০
জাডেজা ২-১-১১-০, প্রজ্ঞান ২-১-১-০। |
|
|