লন্ডনে ফের প্রকাশ্যে এল বর্ণবিদ্বেষের ঘটনা। কয়েকশো লোকের চোখের সামনে প্রহৃত হলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত এক প্রৌঢ়। বাবাকে বাঁচাতে জনে জনে সাহায্য চাইলেন বছর একুশের তরুণী। স্রেফ তাকিয়ে দেখল সবাই, এগিয়ে এল না এক জনও।
২৬ জানুয়ারির ঘটনা। প্রায় দু’মাস হতে চলল, গ্রেটার ম্যাঞ্চেস্টারের পুলিশ এখনও ধরতে পারেনি অপরাধীদের। হন্যে হয়ে সাক্ষী খুঁজছেন তাঁরা। কিন্তু সে দিনের ঘটনা সামনে থেকে ‘উপভোগ’ করেছিলেন অন্তত শ’দুয়েক লোক। জানালেন ৫৬ বছর বয়সী ব্যাঙ্ক অফিসার প্রকাশ পটেল এবং তাঁর মেয়ে দেবযানী।
ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের দারুণ ভক্ত প্রকাশ। গত ২৫ বছর ধরে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে যাচ্ছেন। সে দিনও মেয়েকে নিয়ে ফুলহাম-ম্যানইউয়ের ফুটবল ম্যাচ দেখতে গিয়েছিলেন। ফেরার সময় একটা ট্রাম ধরেন তাঁরা। ভিড়ও ছিল ভালই। ইতিমধ্যে এক দল লোক ট্রামে উঠে। তাঁদের দিকে এগিয়ে এসে কটুক্তি, বর্ণবিদ্বেষী মন্তব্য করতে শুরু করে লোকগুলো। প্রকাশ বলেন, “প্রচণ্ড অপমানজনক লাগছিল আমার আর মেয়ের। এক সময় সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়। ওদের বলি, ‘দয়া করে ভদ্র ব্যবহার করুন’। ব্যস, এর পরেই মারতে শুরু করে ওরা।”
প্রকাশের চোখে-মুখে-মাথায় একটার পর একটা ঘুষি এসে পড়তে শুরু করে। বলেন, “দু’টো ঘুষি খাওয়ার পরেই চোখে কেমন অন্ধকার লাগছিল। মনে হল, এ বার হয়তো জ্ঞান হারাবো। কিন্তু এত ভিড় ছিল ট্রামে, ওই অবস্থাতেও সোজা হয়েই দাঁড়িয়েছিলাম।” আশপাশে দু’শো লোকের ভিড়, প্রকাশ-দেবযানীকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি কেউ। প্রকাশের কথায়, “এর মধ্যেই কোনও রকমে ট্রামের একটা কোণে এসে হেলান দিয়ে দাঁড়ালাম। এ বার হুমকি, ঝামেলা মেটাতে চাইলে ট্রাম থেকে নেমে যান।” এর পরই ফের ঝাঁপিয়ে পড়ে দুষ্কৃতীরা। দেবযানী বললেন, “মনে হচ্ছিল, বাবাকে এ বার ওরা মেরেই ফেলবে। টেনে সরানোর চেষ্টা করছিলাম।” সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল, একমাত্র দেবযানীই ওদের আটকানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিল। কিন্তু সে তো বৃথা চেষ্টা। তাঁর বাবাকে অন্তত ১৯ বার ঘুষি মারে আততায়ীরা। চোখেমুখে কালশিটে পড়ে যায় প্রকাশের। শেষে জ্ঞান হারান তিনি।
নিউ মস্টনে বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকেন দেবযানী। সমাজের এই চেহারাটা এত দিন দেখার ‘সৌভাগ্য’ হয়নি। বললেন, “পাগলের মতো চিৎকার করছিলাম, কিন্তু ওদের আটকাতে কেউ এক বারও এগিয়ে এল না, কিচ্ছু বলল না পর্যন্ত। একে মহিলা, তার উপর আমার ছোটখাটো চেহারা। আমি বুঝতে পারলাম না, কেন কেউ কিছু করল না!” সাত জনের দলটা ট্রাম থেকে নেমে যাওয়ার পর এক জন অবশ্য এগিয়ে আসেন। দেবযানীকে একটা ফোন নম্বর দিয়ে জানান, তিনি সাক্ষী দিতে রাজি। “কোথায় ছিলেন তিনি, যখন বাবাকে ওরা ও রকম নৃশংস ভাবে মারছিল। সব চেয়ে খারাপ লেগেছিল তখন। সমাজের উপর বিশ্বাসটাই হারিয়ে ফেলেছি আমি”, আক্ষেপ তরুণীর।
পরে পুলিশ স্টেশনে সে দিনের ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ দেখেন বাবা-মেয়ে। ক্যামেরায় আততায়ীদের একটাও ছবি ওঠেনি। ওঠা সম্ভবও ছিল না। কারণ বাসের যাত্রীরা প্রায় হুমড়ি খেয়ে মারধরের দৃশ্য দেখছিলেন। তাদের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় অপরাধীরা। কেউ কেউ আবার লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে ছুটে আসেন, এক ঝলক যদি দেখা যায়। দেবযানী বলেন, “ফুটেজটা যখন দেখছিলাম, মেরুদণ্ড বেয়ে ঠান্ডা হিমশীতল স্রোত নেমে যাচ্ছিল।” বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যান মেয়েই। তত ক্ষণে তিনি জ্ঞান হারান, চোখের তলায় কালো ছোপ।
দু’সপ্তাহ ছুটি নিয়ে বাড়িতে ছিলেন প্রকাশ। একা, কারও সাহায্য ছাড়া, এখনও ভাল করে হাঁটতে পারছেন না। মানসিক ভাবে পুরোপুরি ভেঙে পড়েছেন। বললেন, “এর পর আর কোনও দিন সরকারি বাসে-ট্রামে চড়বো না।” |