|
|
|
|
এক থা শিখর |
‘এক থা টাইগার’। বলতেই যেমন সলমন খান ভেসে ওঠেন, তেমন ভারতীয় ক্রিকেট মহলে
সেই পেশিবহুল খানের ব্যাটিং সংস্করণ যেন শিখর ধবন। ব্যাট ছাড়া মাঠের বাইরেও বন্ধুরা তাঁকে
টেস্ট আবির্ভাবের
আগে থেকেই এই ইমেজারিতে চেনেন। ক্রিকেটের নতুন তারকাকে কাছ থেকে দেখে লিখছেন দীপ দাশগুপ্ত |
কোনও মানুষ যে নিজের বাইসেপসের প্রেমে এমন মশগুল থাকতে পারে, শিখর ধবনকে না চিনলে সেটা বিশ্বাসই হত না!
লক্ষ করে দেখবেন, শিখর হাফ হাতা শার্ট পরলেও হাতাটা গুটিয়ে বাইসেপসের ওপর তোলা থাকে। বাইসেপসের উপর বড় বড় ট্যাটু। জিমে দেখেছি, অন্য সব ধরনের এক্সারসাইজ, ক্রিকেটীয় প্রস্তুতি-টস্তুতি সেরে ফেলার পর সবার শেষে নিজের বাইসেপস নিয়ে পড়বেই ও। তার পর লম্বা চলবে বাইসেপ-চর্চা, তাদের লালনপালন।
বাইসেপসের প্রতি এই পরম মমত্বের সঙ্গে যোগ করুন বুক চিতিয়ে সামান্য দুলে দুলে হাঁটাটা। চোখের চাহনির উদ্ধত, থোড়াই কেয়ার ভাব। সবটা মিলিয়ে যে ছবি ফুটে উঠবে তাতে একটা অদ্ভুত মস্তানি, একটা সব নিয়মকে এক ফুঁয়ে উড়িয়ে বেড়া ভাঙার ব্যাপার রয়েছে। আর তার সবটাই ভীষণ ভাবে লার্জার দ্যান লাইফ। দেখলে প্রথমেই মনে হবে উফ! ছেলেটার কী ভীষণ অ্যাটিটিউড!
আমারও সে রকমটাই মনে হয়েছিল। কিন্তু শিখরকে কাছ থেকে চেনার পরে বুঝেছি ছেলেটা যতটা আবেগপ্রবণ, ততটাই খাঁটি।
শিখরের হাঁটা-চলা, হাবভাব, দূর থেকে যেটাকে একটা আরোপিত অ্যাটিটিউড বলে মনে হয়, আসলে সেটাই ওর ক্ষেত্রে খুব স্বাভাবিক আচরণ। তার মধ্যে কোনও রকম ভণিতা নেই। সত্যিই ভাল ছেলে। তবে প্রথাগত ভাবে ‘ভাল’ বলতে যা বোঝায়, গতে বাঁধা সেই সমীকরণে ফেলতে গেলে কিন্তু অঙ্ক কিছুতেই মিলবে না। মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলার ‘গুড বয়’ ও নয়। বরং আমরা সবাই জানি, শিখরকে কোনও কিছু বলে কোনও লাভ নেই। ও নিজে যেটা ভাল বুঝবে, সেটাই করবে। ময়দানি ভাষায় আমরা যাকে বলি ‘হিলা হুয়া’। শিখর খানিকটা অন্তর্মুখী বলেই ওর সঙ্গে আলাপটা জমতে একটু সময় লাগে। কিন্তু এক বার বন্ধুত্ব হয়ে গেলে খালি বলে দেখুন, ‘‘শিখর, ইয়ার তু মেরা ইয়ে কাম কর দে।’’ সেই কাজটা নিয়ে আর দ্বিতীয়বার মনে করাতে হবে না। যাকে বলে ইয়ারোঁ কে ইয়ার, শিখর ঠিক সেটাই।
তবে শিখরের সব ব্যাপারটাই খুব বলিউডের নায়ক মার্কা। ফিল্মি। রাজকীয় মাপের। নিজের নিয়ম ও নিজে বানায়। সমাজ, সামাজিকতা, কোনও কিছুর তোয়াক্কা করে না। আর পাঁচ জন যে ব্যাপারটাকে স্বাভাবিক বলবে, শিখর ঠিক তার উলটো পথে যাবে। অঙ্ক কষে, হিসাব করে চলার বান্দা নয় যে! না তো ইমেজের ধার ধারে। ও সেটাই করে ওর হৃদয় ওকে যেটা করতে বলে। যে কারণে ওকে আমার অনেকটাই সলমন খানের মতো লাগে।
|
|
আজকাল একটা কথা খুব শোনা যায়, ‘থিঙ্ক আউট অব দ্য বক্স’। শিখরের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটাকে একটু বদলে নিতে হবে। শিখর ছেলেটা নিজেই আগাপাঁশতলা আউট অব দ্য বক্স! এই যে আজকাল ক্রিকেটারদের ট্যাটু করার একটা চল হয়েছে সেটার পায়োনিয়র কিন্তু শিখর। ক্রিকেট বরাবরই জেন্টলম্যানস গেম। তাতে ট্যাটু শুনে যে যুগে আমাদের দেশে লোকের চোখ কপালে উঠে যেত, সেই সময় শিখরই প্রথম হাতে ট্যাটু করিয়েছিল। তার পরে মাঝে চুলটা কেটে মোহক স্টাইল করে ফেলল, পিছনে ছোট্ট টিকি। ভাবুন ক্রিকেটারের মাথায় মোহক! সাধারণ ভাবে কেউ ভাবতে পারবে?
একটু আগে বলছিলাম না— মস্তিষ্ক নয়, হৃদয়ের টানে জীবন কাটায় শিখর। এটাও যোগ করতে চাই যে, ছেলেটা হৃদয়ের কথা শুনে চলার সাহসও রাখে। একটু ব্যক্তিগত চর্চা মনে হলেও উদাহরণটা না দিয়ে পারছি না। গত বছর আইপিএলের কথা বলছি। ডেকান চার্জার্সের সঙ্গে খেলার মাঠে দেখি এক ভদ্রমহিলা পতাকা নিয়ে ছোটাছুটি করছেন। টিম মালিকদের কেউ নন, কিন্তু খুব সপ্রতিভ এবং হুল্লোড়বাজ। খোঁজ নিয়ে জানলাম উনি শিখরের বান্ধবী আয়েষা। অস্ট্রেলিয়ার প্রবাসী বাঙালি। শিখরের থেকে প্রায় বছর বারো বড় হবেন। বড় মেয়ে আছে। তো শিখর গত অক্টোবরে আয়েষাকে বিয়ে করেছে। সুখে সংসার করছে। আমি যেটা বলতে তাই, সেটা হল সাতাশ বছর বয়সের অন্য কোনও উদীয়মান তারকা এত স্বাভাবিক ভাবে এই পদক্ষেপ নিত কি না জানি না। কিন্তু শিখর যাকে ভালবেসেছে তার সঙ্গে ঘর বাঁধার আগে কিন্তু মনের অঙ্কটার বাইরে আর অন্য কোনও অঙ্ক নিয়ে ভাবেনি।
২০০৪ অনূর্ধ্ব উনিশ বিশ্বকাপের হাত ধরে ভারতীয় ক্রিকেটে ওর বিস্ফোরক আত্মপ্রকাশ। আমরাও সেই সময় শুনেছিলাম যে দিল্লিতে একটা ছেলে উঠছে, যে অনেকটাই গৌতম গম্ভীরের মতো। তার পরে দলীপ ট্রফির ম্যাচ খেলতে গিয়ে অসমে ওকে প্রথম দেখলাম। এক ঝলক টাটকা হাওয়ার মতো লেগেছিল। কিন্তু গৌতম তো দূরের কথা, কারও সঙ্গেই ওকে মেলানো যায় না।
এমনিতে দিল্লির ছেলেদের একটা ব্যাপার থাকে। বিরাট কোহলিও যেমন ট্যাটু করিয়েছে। দু’জনেই খুব আক্রমণাত্মক ক্রিকেটার। দারুণ ফুর্তিবাজ। দু’জনেরই ক্রিকেট ঘরানাটা দিল্লি। কিন্তু ওই পর্যন্তই। বাকিটা একেবারে আলাদা। বিরাটকে দেখবেন, নিজেকে আগামী দিনের নেতা হিসাবে গড়ে তুলছে। আজকাল নিজের সব কাজের মধ্য দিয়েই রোল মডেল হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। শিখর সেখানে নেতা হতে চায়, কিন্তু তার জন্য কোনও প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়ার কথা একেবারেই ভাবে না। আমার কাছে ও হল আনকাট ডায়মন্ড। র্য। যার নিজের উপর আর নিজের যোগ্যতার উপর এতটাই অগাধ বিশ্বাস রয়েছে যে বাদবাকি কিছুর তোয়াক্কা করে না।
|
|
বাঙালি বৌ আয়েষা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে শিখর ধবন |
তোয়াক্কা করে না বলেই বোধহয় টেস্ট ক্রিকেটে এমন তুলকালাম অভিষেকটাও করে ফেলল।
অন্য যে কোনও ক্রিকেটার হলে কী করত? অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে অভিষেক টেস্টে নেমে প্রথমে বলটা দেখে নিত। কিন্তু শিখর কী করল? না ধুন্ধুমার ব্যাটিংয়ে ৮৫ বলে সেঞ্চুরি করে রেকর্ড গড়ে ফেলল! ওর ইনিংসটা চলার সময় আমি একটা ইন্টারনেট চ্যাট শো-এ ছিলাম। সেখানে এক ঘণ্টার আলোচনায় ড্যামিয়েন মার্টিন, স্টুয়ার্ট ম্যাকগিলরা শিখরকে নিয়েই কথা বলে চলল অন্তত চল্লিশ মিনিট। একেবারে মুগ্ধ! ব্যাট হাতে ওর মস্তানিটা দারুণ মনে ধরেছে অজিদের। এ ভাবে যে কেউ অভিষেক টেস্টে খেলতে পারে, সেটা ওরাও কল্পনা করতে পারেনি। শুধু অস্ট্রেলীয়রাই নয়, টেস্টে আত্মপ্রকাশে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছে শিখর। ওকে এখনই সহবাগের মতো ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার বলা শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রথম দিন খেলা না হওয়ায় অনেকেই ভাবছিলেন টেস্টটা মাঠে মারা গেল। এখন কিন্তু শিখরের ব্যাটিংয়ের জন্যই ম্যাচটা ওপেন হয়ে গিয়েছে।
এমনিতে ঘরোয়া ক্রিকেটে শিখরের জন্য প্রতিপক্ষ হিসাবে বরাবরই আলাদা করে পরিকল্পনা করতে হয়। এ বার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অন্য দলগুলোকেও সেটা করতে হবে। সামনে দক্ষিণ আফ্রিকা সফর। ধরে নেওয়া যায়, তাতে ও যাবে। প্রতিপক্ষ দলগুলো এখন থেকেই ওর খেলা কাটাছেঁড়া করতে বসে যাবে। মানসিক ভাবেও চাপে ফেলার চেষ্টা করবে। শিখর অবশ্য মানসিক ভাবে ভীষণ মজবুত। টেকনিকের দিকটা নিয়ে যদি একটু খাটে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও ওকে আটকানো যাবে না। প্রতিপক্ষ দলগুলোকে একটা সতর্কবার্তা এখনই দিয়ে রাখা যায়। শিখরকে স্লেজিং করতে চাও করো, কিন্তু খুব সাবধান! ও সবটা হজম করে যা ফেরত দেবে সেটা সামলানোর জন্য তৈরি থেকো কিন্তু! পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করাটাই শিখরের স্বভাব। আর পার্শ্বচরিত্র হওয়া ওর ধাতে নেই।
বললাম না, শিখর হল বরাবরের হিরো!
|
এক নজরে |
বিশেষ পছন্দ
বাইশ লক্ষ টাকার অতিকায়
হায়াবুসা বাইকে বেরিয়ে পড়া। |
বিশেষ দ্রষ্টব্য
হাতের ট্যাটু। বিরাট কোহলির মতো
তাঁরও এই নেশাটা আছে। |
জিগরি দোস্ত
বিরাট কোহলি এবং হরভজন সিংহ।
|
ডাকনাম
কেউ কেউ বলে ‘জাঠজি’। ভারতীয় শিবিরে
হালফিল ডাকা হচ্ছে ‘শিক’ বলে। |
দেহসৌষ্ঠব
টি-শার্ট খুলে দাঁড়ালে পেশাদার কুস্তিগিররাও
লজ্জা পেতে পারেন। পুরোদস্তুর সিক্স প্যাকস। |
বাঙালি মিষ্টি
একেবারেই পছন্দ নয়।
|
অন্য পরিচয়
বাংলার জামাই। স্ত্রী বাঙালি। নাম আয়েষা মুখোপাধ্যায়। |
বাংলার জ্ঞান
মাত্র একটা লাইনই জানেন। ‘আমি তোমাকে ভালবাসি’। |
ক্রিকেটের অন্য ক্লাসে
দিল্লির রোশনারা স্টেডিয়ামে রঞ্জি ম্যাচের
পর
মাঝে মাঝেই একটা দৃশ্য দেখা যায়।
স্ত্রী
আয়েষা
গ্লাভস পরে ব্যাট করছেন।
বল
করছেন শিখর ধবন। |
বিতর্কের বাইশ গজে
একবারই নেমেছিলেন। দিল্লি নেটে ঢুকে পড়েছিলেন
ডেকান চার্জার্সের জার্সিতে। যা নিয়ে তৎকালীন দিল্লি
কোচ মনোজ প্রভাকরের সঙ্গে ভাল রকম ঝামেলা
বাঁধে।
পরে প্রভাকরের চাকরিও যায়। |
(তথ্য: রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়) |
|
|
|
শিখরের কোচ তারক সিংহের কথা |
• ও যখন আমার কাছে এসেছিল, তখন ওর বয়স বারো। দেখেই বুঝেছিলাম, ওর মধ্যে টিম ইন্ডিয়ায় খেলার সম্ভাবনা আছে।
• শেষ দু’বছর তো টিমে ঢুকতে পারেনি শুধু ওপেনিং স্লটে গৌতম গম্ভীর আর বীরেন্দ্র সহবাগ খেলছিল বলে। না হলে কবেই টেস্ট খেলা হয়ে যেত শিখরের। আমি ওর জন্য খুব খুশি।
• ওর সব চেয়ে বড় গুণ হল, ওর হ্যান্ড আই কো-অর্ডিনেশন। সহবাগের পর কারও এত ভাল হ্যান্ড আই কো-অর্ডিনেশন আমি অন্তত দেখিনি।
• দিল্লিতে ওর বাবার প্লাস্টিকের ব্যবসা। ওর ভ্যালুস খুব স্ট্রং। খুব কম প্লেয়ারকেই দেখেছি ওর মতো নিষ্ঠা সহকারে প্র্যাক্টিস করতে।
• ওর বয়স সাতাশ হতে পারে। কিন্তু খুবই ম্যাচিওরড। আর ক্রিকেটে দেওয়ার জন্য ওর অনেক কিছু আছে।
• আইপিএল ওকে অনেক সাহায্য করেছে। বিশ্বের সেরা বোলারদের সামলেছে। নিঃসন্দেহে সেটা তফাত গড়ে দেয়।
• তবে ওর আসল পরীক্ষা হবে দক্ষিণ আফ্রিকা সফর।
|
(সাক্ষাৎকার নিয়েছেন স্বপন সরকার) |
|
|
|
|
|
|