মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বনাম মীরা পাণ্ডে। মহাকরণ এবং রাজ্য নির্বাচন কমিশনের এই দ্বন্দ্বেই এখন পঞ্চায়েত ভোটের ভবিষ্যৎ ঘিরে চূড়ান্ত সাংবিধানিক ও আইনি জটিলতার মেঘ।
দ্বন্দ্বের মূলে রয়েছে ক’দফায় ভোট হবে, সেই প্রশ্নটি। কোন বাহিনীর পাহারায় ভোট হবে, তাই নিয়েও সংশয় রয়েছে। কিন্তু আসল সমস্যা তৈরি হয়েছে ভোটের দিনক্ষণ নিয়ে। সরকার চাইছে দু’দফায় ভোট করতে। কিন্তু রাজ্য নির্বাচন কমিশনের মতে, ভোট হওয়া উচিত তিন দফায়। সে কারণে তিন-তিন বার রাজ্যের প্রস্তাব ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডে। দু’পক্ষই আইনি অধিকার নিয়ে নিজস্ব অবস্থানে অনড়। প্রশাসনের অনেকেই এখন বলছেন, এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে পঞ্চায়েত ভোটের ভবিষ্যৎ চলে যাবে বিশ বাঁও জলে।
কমিশনের বক্তব্য, ভোট পরিচালনা করার সাংবিধানিক অধিকার তাদের। সুতরাং নির্বাচনের দিনক্ষণ এবং ক’দফায় ভোট হবে, তা ঠিক করার ক্ষেত্রে তাদের সুবিধা-অসুবিধার কথা রাজ্যকে মানতে হবে। অন্য দিকে, রাজ্য সরকার মনে করছে, পঞ্চায়েত আইন মোতাবেক পঞ্চায়েত দফতর কমিশনের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে ভোটের দিনক্ষণ ঠিক করার অধিকারী। তার অর্থ, দিন ঠিক করবে রাজ্যই, কমিশন শুধু মতামত দিতে পারে। এই দুই স্ববিরোধী অবস্থানের আবর্তেই আপাতত আটকে পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিন ঠিক করার প্রক্রিয়া। এই অচলাবস্থা কবে মিটবে, তা কেউ জানে না।
প্রশ্ন উঠেছে, আইন কী বলছে? পঞ্চায়েত দফতরের কর্তারা মনে করছেন, এই যে তিন দফা চিঠি চালাচালি হল, তা পঞ্চায়েত নির্বাচন আইনের ৪২ ধারা অনুযায়ী ‘কনসালটেশন’। এই ধারা মোতাবেকই আলোচনা মেটার পর পঞ্চায়েত দফতর ভোটের দিন ঘোষণা করতে পারে। যদি পরস্পর বিরোধী মত উঠে আসে, তা হলে সরকার চাইলে একতরফা ভাবেই দিন ঘোষণা করতে পারে। |
মীরা পাণ্ডে |
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় |
|
কিন্তু কমিশন কি তা মানতে বাধ্য? পঞ্চয়েত নির্বাচন আইনের ৪৩ ধারার ১ উপধারায় বলে আছে, কমিশন যদি রাজ্যের সঙ্গে দিন ঘোষণা নিয়ে সহমত হয়, তা হলে পরবর্তী পর্যায়গুলি (মনোনয়ন পেশ থেকে ফলপ্রকাশ) বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়ে দেবে। আর তাদের যদি আপত্তি থাকে? সে ক্ষেত্রে ৪৩ ধারার ২ উপধারা মেনে কমিশন সরকারকে বলতে পারে, আপনারা দিন ঘোষণার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করুন। যদি সরকার তা করতে রাজি না হয়? তা হলে কমিশনও ভোট প্রক্রিয়া নিয়ে এগোবে না। ফলে অচলাবস্থা।
কমিশনের কি এই আইনি অধিকার রয়েছে? রাজ্যকে নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডে যে চিঠিটি পাঠিয়েছেন, তাতে বলে হয়েছে, সংবিধানের ২৪৩ ধারায় বলা হয়েছে, ভোটার তালিকা থেকে ভোট পরিচালনার যাবতীয় অধিকার ও দায়িত্ব কমিশনের। সেই দায়িত্ব স্মরণে রেখেই রাজ্য সরকার দিন ঘোষণার ক্ষেত্রে কমিশনের মতামতকে গুরুত্ব দিক। মীরা পাণ্ডে চিঠিতে স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন, সরকার সংঘাতের বদলে সহমতের ভিত্তিতে দিনক্ষণ ঠিক করুক।
অনেকে এই ক্ষেত্রে পঞ্চায়েত নির্বাচন আইনের ১৩৭ ধারার প্রসঙ্গও তুলেছেন। সেই ধারার ২ উপধারায় কমিশনকে বিশেষ ক্ষমতা দিয়ে বলা হয়েছে, নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি হলে তা দূর করতে কমিশন যে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সে ক্ষেত্রে কমিশন রাজ্য সরকারের পরামর্শ নিতেও বাধ্য নয়। অনেকেই মনে করছেন, এই অস্ত্রে বলিয়ান হয়েই রাজ্যের প্রস্তাব তিন বার ফিরিয়ে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
প্রশ্ন উঠেছে, নির্বাচন পরিচালনা আর নির্বাচনের দিনক্ষণ ঠিক করা কি এক? পঞ্চায়েত নির্বাচন আইন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল প্রশাসনিক মহল বলছে, আইনে বলা হয়েছে, দিন ঠিক করার দায়িত্ব রাজ্য সরকারের। তবে তারা কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করতে পারে। দিন ঘোষণার পরে বিজ্ঞপ্তি জারি থেকে শুরু হয় নির্বাচন প্রক্রিয়া। সেখান থেকে সব দায়িত্ব কমিশনের। তবে ওই অংশ এ-ও বলছে, আইনে যা-ই থাক, ভোট করানোর দায়িত্ব যে হেতু কমিশনের, তাই তাদের মতকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত সরকারের।
সরকার অবশ্য এখনও সংঘাতের আবহই বজায় রেখেছে। বাজেট পেশ হওয়ার পরে পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিন ঘোষণার দিকে এগোচ্ছে তারা। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় এ দিন বলেন, “রাজ্যের নির্বাচন কমিশন তার সীমা অতিক্রম করছে। রাজ্যের পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ। কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোট করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।” পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ও বলেন, “পঞ্চায়েত আইনে যা বলা রয়েছে, তেমনই কাজ হবে। ভোটের দিন জানিয়ে রাজ্য বিজ্ঞপ্তি দেবে। তার পর কমিশন নির্বাচন সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি জারি করবে।”
রাজ্য পুলিশ না কেন্দ্রীয় বাহিনী, কাদের পাহারায় ভোট হবে, তা নিয়েও মতভেদ রয়েছে। কমিশন সূত্রে খবর, মীরা পাণ্ডেকে অধিকাংশ জেলাশাসকই স্পষ্ট জানিয়েছেন, জেলায় শাসকদলের গোষ্ঠী-দ্বন্দ্ব এবং দুষ্কৃতীদের উপদ্রব যে ভাবে বাড়ছে, তাতে কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে এবং বেশ কয়েক দফাতেই পঞ্চায়েত ভোট করানো উচিত। কমিশন সূত্রে খবর, মীরাদেবীও এই বিষয়ে জেলাশাসকদের সঙ্গে একমত।
এমন পরিস্থিতি সত্ত্বেও সরকারের এই অনড় অবস্থানকে স্বাভাবিক ভাবেই সমালোচনা করেছেন বিরোধীরা। মুকুলবাবুর মন্তব্য প্রসঙ্গে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, “উনি এক জন সাংসদ হয়ে কী ভাবে এ কথা বললেন, জানি না। এটা ঔদ্ধ্যতের লক্ষণ। নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক সংস্থা। এ কথা বলার মানে তার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রকাশ করা।” কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়া বলেন, “রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী জেদাজেদি না করে মীরা পাণ্ডের চিঠিকে মান্যতা দিয়ে কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে তিন দফায় ভোট করান।” পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, রাজ্যে অবাধ ও নির্বিঘ্নে যে ভোট সম্ভব, তিনটি উপ-নির্বাচনেই তা প্রমাণিত। মানসবাবুর পাল্টা যুক্তি, “কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়েই ওই ভোট করানো হয়েছে। তা কি পার্থবাবু ভুলে গেলেন!” |