আবার দিল্লির স্বপ্ন দেখছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! কিন্তু কী ভাবে? সেই প্রশ্ন নিয়ে জল্পনায় আপাতত কৌতূহলী বাংলার রাজনীতি।
আন্তর্জাতিক নারী দিবসে শুক্রবার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে দলের মহিলা সংগঠনের মঞ্চ থেকে তৃণমূল নেত্রী ঘোষণা করেছেন, আর দু-তিন মাসের মধ্যেই হবে লোকসভা ভোট। রেল মন্ত্রকও আবার ফিরে আসবে তৃণমূলের হাতে।
কিন্তু রেল কী ভাবে ফিরবে তৃণমূলের হাতে? স্বাভাবিক অঙ্কই বলছে, সে ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারে যোগ দিতে হবে তৃণমূলকে। মমতার এ দিনের বক্তব্যের সূত্র ধরে তাই জল্পনা শুরু হয়েছে তা হলে কি জাতীয় স্তরে কোনও জোটে ফিরে যাওয়ার অঙ্ক কষতে শুরু করেছেন মমতা? কিন্তু কার সঙ্গে জোট? তা নিয়ে উচ্চবাচ্য করেননি তিনি। দলের মহিলা সংগঠনের সভায় এ দিন তাঁর মন্তব্য, “আর তো দু-তিন মাসের মামলা! লোকসভা ভোট হবে। রেল মন্ত্রক দরকার হলে তৃণমূলের কাছেই আসবে।” |
নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামের অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী। —নিজস্ব চিত্র |
শুধু রাজনীতির সঙ্গে যুক্তরাই নন, তৃণমূলের অন্দরেও এই নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। শাসকদলের ভিতরেই আলোচনা, জাতীয় স্তরে ধরার মতো হাত তো দু’টিই। কংগ্রেস এবং বিজেপি। বিরোধী রাজনৈতিক দলের কোনও কোনও অংশের মতে, মমতা আবার কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মেলাতে পারেন! কেন এবং কী ভাবে? অনেকেই বলছেন, সম্প্রতি উপনির্বাচনের অঙ্ক থেকে স্পষ্ট, কংগ্রেস এবং তৃণমূল একজোট থাকলে এই রাজ্যে বামেরা এখনও পায়ের তলায় জমি খুঁজে পাবে না। আবার এই দুই দল আলাদা হয়ে গেলে লাভ বিরোধী বামেদেরই। সে কারণেই ছ’শতাংশ ভোট কমে যাওয়া সত্ত্বেও কংগ্রেস-তৃণমূল ভোট ভাগাভাগির লাভ তুলে উপনির্বাচনে নলহাটি কেন্দ্রটি জিতে নিয়েছে তারা। তৃণমূলের একাংশের বক্তব্য, ওই ভোট থেকে আরও একটা বিষয় পরিষ্কার। তা হল, তৃণমূল প্রায় দু’বছর ক্ষমতায় থাকার পরেও বামেরা প্রতিষ্ঠান-বিরোধী হাওয়াকে বিশেষ কাজে লাগাতে পারেনি। উপরন্তু কংগ্রেস তাদের ভোট অনেকাংশেই ধরে রাখতে পেরেছে বলেও মত অনেকের।
কিন্তু ইদানীং কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূলের যা সম্পর্ক তাতে জোট হওয়া কি সম্ভব? এ দিনও কংগ্রেসের কড়া সমালোচনা করেছেন মমতা। ওই মঞ্চ থেকেই তিনি বলেছেন, “কেউ কেউ মনে করেন বাংলার মুখ বন্ধ করতে হবে। রেলের প্রকল্প বন্ধ করতে হবে। কী করে করবে? আমি তো অর্ধেক করেই দিয়ে এসেছি। বাকি যা আছে, তা-ও করে দেব। অপমানের বদলে মান কী ভাবে আদায় করতে হয়, বাংলার মানুষ তা জানেন। মানুষই তার জবাব দেবেন।” বলেছেন, “যেই দেখছে বাংলা ভাল কাজ করছে এগিয়ে যাচ্ছে, অমনি গ্রামোন্নয়নের টাকা বন্ধ করছে। কত আর বন্ধ করবে? আর তো দু-তিন মাস! যারা কাজ করতে জানে, তারা কাজ খুঁজে নেয়! যারা কাজ করতে জানে, কাজের ধরন তারা ঠিক করে নেয়।”
এ সব সত্ত্বেও কেউ কেউ বলছেন, রাজনীতিতে শেষ কথা বলা অসম্ভব। হতে পারে, জোট না করেই লোকসভা ভোটে গেলেন মমতা। তার পরে ভাল আসন জিতে দর কষাকষি করে সমঝোতা করলেন কংগ্রেসের সঙ্গে। সাম্প্রতিক সমীক্ষাগুলিতে মোটামুটি ভাবে ইঙ্গিত, আগামী লোকসভা ভোটে বিজেপির দিকেই পাল্লা ভারী। সে ক্ষেত্রে মমতা তখন কংগ্রেসের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেন।
মমতা বিজেপির দিকে যেতে পারেন, এমন একটি সম্ভাবনার কথাও উঠেছে। বিজেপির দিকে পাল্লা ভারী এই যুক্তি থেকেই কেউ কেউ এমন সম্ভাবনার কথা বলছেন। কিন্তু তৃণমূলের মধ্যে থেকেই অনেকে এই মতের বিরোধিতা করছেন। তৃণমূলের এক নেতার কথায়, “নেত্রী বহু কষ্টে যে মুসলিম ভোট ব্যাঙ্ক তৈরি করেছেন, বিজেপি-র হাত ধরলে তাতে যে ভাঙন ধরবে, তা উনি ভাল ভাবেই জানেন।” তার উপরে নরেন্দ্র মোদীকে সামনে রেখে বিজেপি-র উত্থান ভাল চোখে দেখছেন না তৃণমূল নেত্রী। সে ক্ষেত্রে কংগ্রেসের হাত ধরার সম্ভাবনাই খোলা বলে মনে করছেন তাঁরা।
কিন্তু শেষ কথা কে বলবে? এই নিয়ে রসিকতা করে দলের এক প্রথম সারির নেতার মন্তব্য, “টিভিতে অনেক সময় কাকাতুয়া-টিয়াপাখির টিপ্পনি দেখি। এখন কাকাতুয়ার পেটে কী আছে কী করে বলব!”
মমতার এই কথা নিয়ে অবশ্য বিরোধীরা কটাক্ষ করতে ছাড়েননি। কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়া বলেছেন, “মুখ্যমন্ত্রী ভাল ছবি আঁকেন জানি। গানও করেন জানি। কিন্তু উনি যে এক জন রাজনৈতিক গণৎকার, এটা জানা ছিল না!” কংগ্রেসের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এবং প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকে প্রকাশ্যে ব্যঙ্গ করে-আসা তৃণমূল নেত্রী আবার সনিয়া গাঁধীর হাত ধরতে চাইবেন কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর তৃণমূলের দিকেই ঠেলে দিয়েছেন মানসবাবু।
বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের কথায়, “কোন ডালটা তিনি (মমতা) ধরতে চান, খোলসা করে বলুন!” কিন্তু সামনে পঞ্চায়েত ভোট ছেড়ে হঠাৎ তৃণমূল নেত্রী যে ভাবে লোকসভা নির্বাচন টেনে এনেছেন, তা নিয়ে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রেরও তির্যক মন্তব্য, “লোকসভা ভোট নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী যা বলেছেন, আমরা তার বিজ্ঞপ্তির অপেক্ষা করছি! তবে আমরা চাই, এখন উনি যেন কলকাতা ছেড়ে পালিয়ে না যান!”
তথ্য বলছে, আগাম ভোটের ঘোষণাকে বারেবারেই দলের কর্মী-সমর্থকদের চাঙ্গা রাখতে ব্যবহার করে থাকেন তৃণমূল নেত্রী। ২০০৯-এর লোকসভা ভোটে সাফল্যের পরে তাঁর ঘোষণা ছিল, রাজ্যে বিধানসভা ভোট এগিয়ে আসবে। আবার রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পরে বলেছিলেন, পঞ্চায়েত ভোট তাঁরা এগিয়ে আনবেন। বাস্তবে এর কোনওটাই কিন্তু ঘটেনি। |