মণিপুরে, ছত্তীসগঢ়ে, পশ্চিম মেদিনীপুরে যে প্রান্তিক মেয়েরা
প্রতিনিয়ত অত্যাচারের বলি হচ্ছে? প্রশ্ন তুলেছেন বোলান গঙ্গোপাধ্যায় |
যৌন নিগ্রহ (যার চরম প্রকাশ ধর্ষণ) যখন ভারতীয় নারীর জীবনচর্যায় প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, তখন দক্ষিণ দিল্লির একটি ঘটনায় জনমানসের তীব্র প্রতিক্রিয়া ও নাগরিক সমাজের পথে নেমে প্রতিবাদ এক নতুন অভিজ্ঞতা। এই প্রথম মনে হচ্ছে, ‘নারীর সমস্যা’, এই তকমার বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে নারীনিগ্রহ। এত কাল ধরে আমাদের দেশে নানা ভাবে যৌন হেনস্থার শিকার হয়েছেন মেয়েরা, ঘরে এবং বাইরে। কিন্তু সেই সমস্যা ছিল একান্ত ভাবেই মেয়েদের নিজস্ব সমস্যা। বৃহত্তর সমাজে তার কোনও মান্যতা ছিল না। যথার্থ মান্যতা ছিল না প্রশাসনের কাছেও। এ বার হয়তো একটা পরিবর্তন ঘটবে। তবে তার জন্য নাগরিক সমাজকে আরও অনেকখানি সচল এবং সচেতন হতে হবে। তা না হলে দিল্লির ঘটনা এবং তার প্রতিক্রিয়া তার পূর্ণ ঐতিহাসিক মর্যাদা পাবে না।
এই প্রসঙ্গে আমাদের নাগরিক সমাজের একটা বিশেষ ব্যর্থতার কথা বলতে চাই। স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন অঞ্চলের ‘প্রান্তিক’ বর্গের মেয়েরা কখনও সেনাবাহিনীর হাতে, কখনও দলীয় রাজনৈতিক কারণে ‘ইজ্জত’ দিয়েছেন বার বার, কার্যত প্রতি দিন। উত্তর-পূর্ব ভারতে এ ঘটনা তো যাকে বলে জলভাত। ছত্তীসগঢ়, ওড়িশা, পশ্চিম মেদিনীপুরে আদিবাসী মেয়েদের তুলে নিয়ে গিয়ে থানায়, পুলিশ বা সেনা-ব্যারাকে ধর্ষণ করাটা যেন নেহাতই স্বাভাবিক ঘটনা! কাশ্মীরের মেয়েরা কলকাতায় এসে বলে গিয়েছিলেন তাঁদের নৈমিত্তিক ধর্ষণের অভিজ্ঞতা। পাহারাদার সেনা বা পুলিশ (কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারের) কেউ কারও চেয়ে কম নয়। আর উচ্চবর্ণের পুরুষরা যে নিত্য দলিত মেয়েদের ধর্ষণ করে, সে তো দলিত মেয়ের সৌভাগ্য বলেই গণ্য হওয়া উচিত, কারণ উচ্চবর্ণের স্পর্শ পাচ্ছে তারা, এ-মতও শুনেছি।
অথচ আমরা প্রায় কখনও দেখিনি, নাগরিক সমাজ এগিয়ে এসে প্রতিবাদ করছে। শর্মিলা চানু ওই দিল্লিতেই অনশনে প্রায় মৃত্যুমুখে পৌঁছেছেন। আমরা একটা অ-রাজনৈতিক মিছিলও সংগঠিত করিনি। আওয়াজ তুলিনি মণিপুরের মেয়েদের নগ্ন মিছিলের পরও। মনে করেছি এটা ‘ওদের’ ব্যাপার। শর্মিলা বা সোনি সোরি আমাদের ঘরের মেয়ে হয়ে ওঠেনি। সোনির যৌনাঙ্গের ভিতর থেকে পাথর পাওয়া গিয়েছে। তাকে টেকনিক্যালি ধর্ষণ বলা যায় কি না, সে তর্কও শুনেছি। গা বাঁচানোর যত রকম যুক্তি আছে, বেছে নিয়েছি। পার্ক স্ট্রিটের মেয়েটি নাইট ক্লাব থেকে ফিরছিল, তাই তার সঙ্গে দিল্লির ঘটনার তফাত আছে, তাই প্রতিবাদ করব কি না ভাবতে হবে, বুঝিয়েছি নিজেদের। এই সব বোঝানো আর বুঝে ওঠার মধ্যেই বেঁচে থেকেছি। আজ তাই দিল্লির মিছিল নিজেকেই প্রশ্ন করতে শেখায়, এই প্রতিবাদে শামিল হওয়ার নৈতিক জোর আমার আছে তো?
তবু, দিল্লি একটা বড় রকমের নাড়া দিল, আইনি বদলের প্রেক্ষিত তো তৈরি হল! অ-রাজনৈতিক নাগরিক প্রতিবাদকে যাঁরা হেয় করেন, তাঁরাও নিশ্চয়ই এই সত্য স্বীকার করবেন। যাঁরা লড়াই করেন তাঁরা জানেন, আইনকে হাতিয়ার করে খানিকটা অন্তত এগোনো যায়।
সেই প্রেক্ষিতেই মনে হয়, অনেক অন্যায় ইতিমধ্যে হয়ে গিয়েছে। আমরা, যারা প্রতিবাদ করিনি, এখনও ‘আমাদের’ সমস্যা নয় মনে করে ‘ওদের’ অপমান আর যন্ত্রণা থেকে ফিরিয়ে নিচ্ছি চোখ, দিল্লির এই প্রতিবাদ তাদের শিখিয়ে দিয়ে গেল যে, অন্ধ হলে প্রলয় তো বন্ধ থাকেই না, অন্ধত্ব আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনও যুক্তিও হতে পারে না। |