প্রবন্ধ ১...
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মেয়েদের নেতা হয়ে উঠুন

রাজধানীতে ২৩ বছরের তরুণীর গণধর্ষণ ও মৃত্যু নিয়ে যা কিছু কথাবার্তা হল, তাতে একটা কথা স্পষ্ট হল। মেয়েদের উপর ব্যাপক এবং ভয়ানক নির্যাতন মোকাবিলার জন্য কী করা দরকার, তার কোনও দিশা রাষ্ট্রের কাছে নেই।
প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণে বললেন, তিনি মেয়েদের ক্ষোভ বোঝেন, কারণ তিনি তিনটি মেয়ের পিতা। মুশকিল হল, যে লোকটা মেয়ে পাচার করে, সে-ও মেয়ের বাবা। যে ধর্ষণ করে অন্যের মেয়েকে, বাড়িতে কন্যা সন্তান রয়েছে তারও। ‘বাড়িতে মা-বোন নেই?’ এই যে সংলাপটা প্রায়ই শোনা যায়, ‘আমারও মেয়ে রয়েছে’ কথাটা তারই উলটো পিঠ। এ কথাকে পাত্তা দেওয়া চলে না, কারণ নিজের মেয়েকে আগলানোর সঙ্গে অন্যের মেয়ের নির্যাতনে কোনও বিরোধ নেই।

দিল্লির মেয়েটির (অনেকে তার নাম দিয়েছে ‘নির্ভয়’) জন্মের ১২ বছর আগে মেয়েরা রাস্তায় নেমেছিল ভয়ানক দুটি ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে। মহারাষ্ট্রের ১৬ বছরের আদিবাসী তরুণী মথুরাকে ধরে থানায় নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ। বাইরে তার বাবা-মা অভিযোগ লেখাবে বলে যখন অপেক্ষা করছিল ধৈর্য ধরে, তখনই থানার ভিতর ধর্ষণ চলছিল মথুরার। আর একটি মেয়ে অন্ধ্র প্রদেশের রামজা বি। তাকেও ধর্ষণ করে পুলিশ, বাধা দিতে গেলে খুন করে স্বামীকে। এই দুটি ঘটনাকে ঘিরে গোটা দেশের মেয়েদের ক্ষোভ দানা বাঁধে, শুরু হয় রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ মিছিল, স্বাক্ষর সংগ্রহ, ধর্না। সেই আন্দোলনের চাপে ১৯৮৩ সালে ধর্ষণের আইন বদল হল। ‘গায়ে আঁচড় নেই, তা হলে ধর্ষণ নয়,’ এমন উদ্ভট কথা আজ অত সহজে যে বলা চলে না, তা সে দিন মেয়েরা রাস্তায় নেমেছিল বলেই।
সত্তর-আশির দশকের সেই আন্দোলন ধর্ষণ-বধূহত্যার জন্য কাঠগড়ায় তুলেছিল রাষ্ট্রকে। মেয়েদের নির্যাতন যে এত সহজ, আর মেয়েদের বিচার পাওয়া যে এত কঠিন, তার কারণ পুলিশ-প্রশাসনের মুখটি হল যৌথপরিবারের পুরুষ অভিভাবকের মুখ। যে মুখ স্বচ্ছন্দে কয়েক লক্ষ বধূহত্যাকে স্টোভের গোলমাল বলে চালিয়ে দেয়, ধর্ষণকে ‘ব্যভিচার’ বলে মেয়েদেরই মারতে আসে। সেই মুখ নগ্ন হতে রাষ্ট্র দুটো স্ট্র্যাটেজি নিল। এক, প্রশাসনের কাজে আরও বেশি করে আনল মেয়েদের। এল মেয়ে পুলিশ, মেয়ে বিডিও-এসডিও, মহিলা জজ। আর দুই, তৈরি করতে লাগল মহিলা থানা, মহিলা আদালত, মহিলা কমিশন, প্রভৃতি।
মেয়েদের জন্য সুযোগ তৈরি করা যে রাষ্ট্রের কাজ, সে কথাটাও তখন সামনে এসেছিল। আজ পঞ্চায়েত কর্তাদের তিন জনে একজনই মেয়ে, মিডিয়ায় চারজনের একজন, পাঁচ জনে একজন ডাক্তারি ছাত্র মেয়ে, তার একটা শিকড় যায় সেই আন্দোলনের দিকেও।
কিন্তু ধর্ষণ-বধূহত্যা কমল না কেন? তবে কি শিক্ষা, স্বরোজগার কিংবা ভোটে জেতার সঙ্গে সম্মানের সঙ্গে বাঁচার কোনও সম্পর্কই নেই? মেয়েদের কাছে এটা বড় বিপদের কথা। যদি স্বামীর হাতে মার খেতে হয় ছেলে-মেয়ের সামনে, যদি ট্রেনে-বাসে, স্টেশনে-বাস স্টপে যে কেউ গায়ে হাত দিতে পারে, তা হলে কী হল পরীক্ষা পাশ করে, নিপুণ হাতে ঘর গুছিয়ে, বা মোটা-মাইনের চাকরি করে?
পঞ্চাশ শতাংশ মহিলা সংরক্ষণ করে বা ছাত্রীদের সাইকেল-স্কলারশিপ দিয়ে রাষ্ট্র এক হাতে মেয়েদের যেটুকু সমতার আশ্বাস দিচ্ছে, অন্য দিকে ধর্ষণের মামলায় চার্জশিট না দিয়ে, অভিযুক্তকে আড়াল করে তা কেড়ে নিচ্ছে। ধর্ষণ বুঝিয়ে দেয় একটি মেয়ে কোনও দিন পুরুষের সমান হতে পারবে না, সে যতই গুণী, ধনী কিংবা জনপ্রিয় হোক। দিল্লির মেয়েদের প্রতিবাদকে যাঁরা ‘ও তো মিড্ল ক্লাসের প্রতিবাদ’ বলে তাচ্ছিল্য করছেন, তাঁরা খেয়াল করছেন না যে ওই মেয়েরা হাড়ে-মজ্জায় নিজেদের অসমতা টের পাচ্ছে। তাই জল-কামানের মুখে দাঁড়াতে পারছে।

কী করলে ধর্ষণের সংখ্যা কমিয়ে আনা যায়?
সে আলোচনার গোড়াতেই ঝাড়ু-বোলানো কথাগুলো বাদ দেওয়া দরকার। ‘সমাজ না বদলালে অবস্থা বদলাবে না’ আর ‘কোনও দিন ধর্ষণ কমবে না’ এ দু’টো একই কথা। দার্শনিক ইম্যানুয়েল কান্ট বলেছিলেন, হাড়-শয়তানদের সমাজেও সুশাসন সম্ভব। এই সমাজেও ধর্ষণ কমানো যাবে, যদি যথাযথ বিধিব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। আর তা করতে চাইলে ভাবতে হবে, কেন কেন্দ্রে বা রাজ্যে মেয়েদের জন্য প্রতিষ্ঠানগুলো হিংসা কমাতে পারল না।
পয়লা কারণ, এগুলিকে এলেবেলে করে রাখা হয়েছে। মহিলা কমিশন তৈরি হয়েছিল মেয়েদের নিরাপত্তা ব্যবস্থার উপর নজরদারির জন্য, আইন সংশোধনের সুপারিশ করার জন্য। মহিলা ক্ষমতায়নের জন্য জাতীয় মিশনের উদ্দেশ্যও প্রায় এক। কিন্তু এই সংগঠনগুলিকে কাজ করার পরিকাঠামোও দেওয়া হয়নি, আর তাদের সুপারিশ একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কার্যকর করার কোনও রীতিও তৈরি হয়নি।
দ্বিতীয় কারণ, মেয়েদের জন্য ‘বিশেষ’ ব্যবস্থা করতে গিয়ে বিচ্ছিন্ন ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে। বহু জায়গায় নিজস্ব এলাকার থানা থেকে মেয়েদের মহিলা থানায় যেতে বলা হয়। ফলে বহু অভিযোগ দায়েরই হয় না। এ দিকে অ-মহিলা থানায় জারি থাকছে নির্যাতিতার প্রতি অশালীন মন্তব্য, সাক্ষ্য সংগ্রহে গাফিলতি, তদন্তে দেরি, ইত্যাদি। বিচার পাওয়ার গোটা প্রক্রিয়াটিই এমন জটিল করে রাখা হয়েছে যাতে মেয়েটি ভয় পেয়ে, হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেয়। সদাশয় পুলিশ কর্তারা প্রায়ই অভিযুক্তের থেকে টাকা নিয়ে ঝামেলা মিটিয়ে ফেলতে বলেন। বিচারকরা বলেন ধর্ষককে বিয়ে করতে। ‘মেয়ের বাবা’ হওয়ার সহানুভূতি থেকেই। মহিলা থানা, মহিলা আদালত রাষ্ট্রের মুখরক্ষা করছে, মুখ বদলাচ্ছে না।

যে কোনও ধর্ষণের ঘটনার মধ্যে নারী-বিদ্বেষ কাজ করে অবশ্যই। সে কথাটা জোর গলায় বললেই খুব জোরালো সমাধানের কথা বলা হয় না। পশ্চিমবঙ্গে গত কয়েক বছরে দেখা যাচ্ছে, চারটি জেলায় লাগাতার ধর্ষণের সংখ্যা অনেকটাই বেশি। রাজ্য পুলিশের পরিসংখ্যান, ২০১১ সালে মুর্শিদাবাদে ধর্ষণের সংখ্যা ৪৩৩, দক্ষিণ ২৪ পরগনা (২৭৪), উত্তর ২৪ পরগনা (২০৩), নদিয়া (১৮৫)। অন্য কোনও জেলাতেই ওই সংখ্যা ৬৫ ছাড়ায়নি। কলকাতার (৪৬) তুলনায় ওই চার জেলায় ধর্ষণ হচ্ছে চার গুণ থেকে দশ গুণ বেশি।
একটি ধর্ষণও সহনযোগ্য নয়। কিন্তু যদি রাজ্যে ধর্ষণের সংখ্যা কমানোর লক্ষ্যে নীতি তৈরি করতে হয়, তা হলে এই জেলাগুলির দিকে বিশেষ নজর দিতেই হবে। তখন কিন্তু কেবল ‘পুরুষতন্ত্রের’ মোকাবিলায় ‘নারী ক্ষমতায়ন’-এর দাওয়াই দিলে হবে না। সমাজ সর্বত্রই পুরুষতান্ত্রিক, নারী ক্ষমতায়ন কোনও জেলাতেই তেমন করে হয়নি। তা হলে ওই চার জেলায় সমস্যা এত বেশি কেন? এগুলি সীমান্তের জেলা, প্রচুর মেয়ে পাচার হয়, সেই কারণেই কি সব মেয়েরই বিপন্নতা বেশি? এই জেলাগুলিতেই কি রাজনীতি বিশেষ করে আড়াল করে দুষ্কৃতীদের, যাতে গণধর্ষণের অভিযুক্তরাও পার পেয়ে যায়? অনেক জেলায় নাকি পুলিশ কর্মীরা ধর্ষণে অভিযুক্তদের থেকে ঘুষ নেন না। এই জেলাগুলিতে কি সেই সংস্কৃতি কাজ করে না? নাকি এই জেলাগুলোতে সব অপরাধই বেশি হয়, তাই ধর্ষণও বেশি?
এমনও হতে পারে যে, এক একটা জেলা, মহকুমা, ব্লকে এক একটি কারণ তীব্র হয়ে উঠছে। সব সময়ে কোনও একটি ‘মৌলিক’ কারণ থাকবে, ধরে নিতে হবে কেন? তার চেয়ে জেলা-ভিত্তিক, ব্লক-ভিত্তিক অনুসন্ধান করে দেখা হোক, কোথায় কোন কারণে নির্যাতন ঘটতে পারছে। কোথায় রাস্তায় আলো নেই, কোথায় সমস্যা অগুন্তি মদের ঠেক, কোথায় পুলিশের দুর্নীতি, কোথায় কুচক্রী রাজনৈতিক নেতা। সেই অনুসারে কোথাও পুরসভাকে আলো লাগাতে বাধ্য করা যায়, কোথাও মিডিয়ার ‘স্টিং অপারেশন’ কাজে দেবে, কোথাও ঘেরাও হয়ে পিছু হঠতে পারেন নেতা। এমন ছোট ছোট প্রতিকার অনেক বেশি কাজ দেয় লোক-দেখানো আধা-খ্যাঁচড়া ক্ষমতার কমিটি-কমিশনের চাইতে।
তার নিদর্শনও রয়েছে। সমাজসেবী, ডাক্তার, আইনজীবীদের সমন্বিত করে থানার মধ্যে ‘মহিলা হেল্প ডেস্ক’ খুলে ভাল ফল পাওয়া গিয়েছে ওড়িশায়। গ্রামসভায় অর্ধেকের বেশি মেয়ে কোনও মদের ভাটি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলে তা সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করা হবে, এই নিয়ম জারি করে বহু চোলাই ঠেক উঠে গিয়েছে পুণেতে। দেশ-বিদেশে কোথাও কাজ দিয়েছে ‘community policing’, পুলিশের কাজে পাড়ার লোকেদের যোগদান, কোথাও বা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর নজরদারি সীমান্তে মেয়ে পাচারে রাশ টেনেছে।
মোট কথা, রাস্তার আলো থেকে বি এস এফ-এর দুর্নীতিমুক্তি, সবই যে ধর্ষণ কমানোর উপায়, সে কথাটা খুব গাঢ় রকমের দাগ কাটা চাই। নইলে মেয়েদের বিচ্ছিন্নতা কমবে না। বিচ্ছিন্নতাই তাদের বিপন্ন করছে।
মেয়ের ‘সম্মান’ বাঁচাতে বাবা-দাদা-বয়ফ্রেন্ড হামেশাই তৈরি। মেয়ের কথাকে সম্মান করার লোক কই? মেয়েদের বক্তব্য ধরে রাখার সরকারি বিধিব্যবস্থাকে কার্যকর করা, আর বাকি প্রশাসনকে সেই কথা অনুসারে কাজ করানো, এ দুটোর জন্যই প্রয়োজন সাহসী নেতৃত্ব। প্রধানমন্ত্রী ‘বাবা’ থেকে ‘নেতা’ হয়ে উঠলে কথাগুলো মনে করিয়ে দিতে হত না।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.