|
|
|
|
ভিসা দিয়েও মিয়াঁদাদের আসা ঠেকিয়েছে দিল্লিই |
প্রেমাংশু চৌধুরী • নয়াদিল্লি |
এক ভিসা-কাণ্ড থেকে শিক্ষা নিয়ে আর এক ভিসা-অস্বস্তি থেকে রক্ষা পেল মনমোহন সরকার।
গত ডিসেম্বর মাসের কথা। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে নতুন ভিসা ব্যবস্থা চালু করতে দিল্লিতে এসেছিলেন পাক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রেহমান মালিক। কিন্তু দিল্লিতে এসেই তিনি ২৬/১১-র মুম্বই-হামলার সঙ্গে বাবরি মসজিদের তুলনা করেন। দাবি করেন, হাফিজ সইদকে গ্রেফতার করেও প্রমাণের অভাবে ছেড়ে দিতে হয়েছে পাক সরকারকে। পরে দেখা যায়, সবই মিথ্যে কথা। রেহমান মালিককে কেন ভারতে আসতে দেওয়া হল, তা নিয়ে এর পর প্রবল চাপের মুখে পড়তে হয় কেন্দ্রীয় সরকারকে। সন্ত্রাস দমনে পাকিস্তান কার্যকর কোনও পদক্ষেপ না করা সত্ত্বেও কেন মালিককে ভারতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলে বিজেপি।
এ বার তাই জাভেদ মিয়াঁদাদকে ভিসা দেওয়া নিয়ে বিজেপি প্রশ্ন তুলতেই আসরে নেমে পড়েছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তারা। দাউদ ইব্রাহিমের বেয়াই দিল্লিতে এলে গোটা ক্রিকেট কূটনীতিটাই যে জলে চলে যাবে, তা পাক প্রশাসন ও ক্রিকেট কর্তাদের বোঝানো হয়। বলা হয়, মিয়াঁদাদ এলে ইউপিএ সরকারকে ঘরোয়া রাজনীতিতে প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে। প্রাক্তন পাক অধিনায়ক যাতে নিজেই না আসেন, তার জন্য কূটনৈতিক যোগাযোগের সমান্তরাল ভাবে ‘ট্র্যাক-টু’ স্তরেও যোগাযোগ করা হয়। আর তার ফলেই মিয়াঁদাদের দিল্লি সফর আটকানো সম্ভব হয়। মিয়াঁদাদ নিজেই জানিয়ে দেন, কোটলায় ভারত-পাক তৃতীয় এক দিনের ম্যাচ দেখতে তিনি দিল্লি যাবেন না। বিতর্ক এড়াতেই তাঁর এই সিদ্ধান্ত।
|
দাউদের বেয়াই মিয়াঁদাদ |
মিয়াঁদাদ কাণ্ডের পরে বেশ কয়েক দিন কেটে গেলেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা মন্ত্রকের আমলারা কেউই এ বিষয়ে মুখ খুলতে নারাজ। কিন্তু গোয়েন্দা সূত্রে জানা যাচ্ছে, মিয়াঁদাদ যাতে নিজেই না আসার সিদ্ধান্ত নেন, ঘুরপথে সেই বার্তা তাঁর কাছে পাঠানো হয়েছিল। কারণ, নীতিগত ভাবে মিয়াঁদাদের ভিসা খারিজ করে দেওয়ার উপায় নেই। বিদেশ মন্ত্রকের কর্তাদের বক্তব্য, সন্ত্রাসবাদীদের ভিসা না দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু তাদের আত্মীয়দের ভিসা দেওয়া হবে না, এমন কোনও নীতি নেই। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তারা আবার বলছেন, মিয়াঁদাদ ভারতে এলেই তাকে দাউদ নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করাটা বাস্তবসম্মত নয়। আবার তা না করা হলেও প্রশ্ন তুলত বিজেপি। মিয়াঁদাদ এখন পাক ক্রিকেট বোর্ডের ডিরেক্টর জেনারেল, দ্বিতীয় ক্ষমতাশালী ব্যক্তি। দিল্লিতে গোয়েন্দারা তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলে, ক্রিকেট সিরিজটাই বন্ধ হয়ে যেত। অন্ধকারে চলে যেত দু’দেশের মধ্যে ক্রিকেট কূটনীতি।
মিয়াঁদাদকে ভিসা দেওয়ার সমস্যা নিয়ে সরকারকে সতর্ক করা হয়েছিল তাঁর ছেলের বিয়ের পরপরই। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার এক প্রবীণ অফিসার বলেন, “দাউদের মেয়ে মাহরুখের সঙ্গে মিয়াঁদাদের ছেলে জুনেইদের যখন শাদি হয়, পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন তখন দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা। আর অন্ধ্রপ্রদেশের রাজ্যপাল ই এস এল নরসিমহন ছিলেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান। সে সময়ই সরকারকে সতর্ক করা হয়েছিল যে, এর পরে দাউদের বেয়াইকে ভারতে আসার ভিসা দিলে রাজনৈতিক প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে।”
সেই সতর্কবার্তা ভুলে কেন ভিসা দেওয়া হল মিয়াঁদাদকে? ওই গোয়েন্দা-কর্তার ব্যাখ্যা, ২০০৮ সালের নভেম্বরে মুম্বইতে আজমল কসাবদের হামলা হয়েছে। হাফিজ সইদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থাই নেয়নি পাক সরকার। তা সত্ত্বেও মনমোহন সিংহ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিতে দিল্লি অনড় থাকলেও পাকিস্তানের সঙ্গে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যোগাযোগ ক্রমে ক্রমে বাড়ানো হবে। সেই অবস্থান থেকেই কাজে লাগানো হয় ক্রিকেট কূটনীতিকে। বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল দেখতে মোহালিতে আসার জন্য পাক প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানান মনমোহন। সদ্যসমাপ্ত ভারত-পাক ক্রিকেট সিরিজও তারই আর একটি মাইলফলক।
সৌহার্দ্যের বাতাবরণ বজায় রাখতেই এই সিরিজের আগে ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে উদার মনোভাব নেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। বস্তুত নতুন ভিসা ব্যবস্থা চালু হওয়ার আগেই পাক ক্রিকেট কর্তা ও ভক্তদের একাধিক শহরের ভিসা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়ে যায়। তাই সে দেশের ক্রিকেট বোর্ডের তরফে যখন মিয়াঁদাদ-সহ কয়েক জনের জন্য গ্রুপ ভিসা চাওয়া হয়, গোয়েন্দা রিপোর্টের অপেক্ষা না করেই তা মঞ্জুর করে দেওয়া হয়। কিন্তু বিজেপি এ নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই টনক নড়ে সরকারের। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব দেখিয়ে বিজেপি যাতে একাই রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে না পারে, তার জন্য কংগ্রেসের জগদম্বিকা পালের মতো নেতারাও মিয়াঁদাদের ভিসার বিরোধিতা করেন। এরই মধ্যে সরকার পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা শুরু করে ট্র্যাক-টু স্তরে।
এক গোয়েন্দা কর্তা বলেন, “এক দিকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের দাবি, অন্য দিকে সৌহার্দ্য রেখে চলা, পাকিস্তানের ক্ষেত্রে এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য রেখে এগোতে হচ্ছে। সমস্যা তৈরি হচ্ছে তাতেই। আর তার ফলেই রেহমান মালিককে আমন্ত্রণ জানানো বা মিয়াঁদাদকে ভিসা দিয়ে ফেলার মতো পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে।” |
|
|
|
|
|