অন্ধকারে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ খুঁজে পেয়েছে ভূতেরাই
রিবর্তনের উতল হাওয়ায় ২০১১-র বাঙালি ভেবেছিল, দিন বুঝি বা বদলাল!
২০১২ দেখিয়ে দিল, কিছুই বদলায়নি। বছর শেষে অন্ধকার আরও গভীর। শুধু ক্রমশ উজ্জ্বল হচ্ছে ভূতের ভবিষ্যৎ।
সেই সব ভূত যারা কখনও সিপিএমের আনিসুর রহমানের গলায় ভর করে, কখনও তৃণমূলের কাকলি ঘোষদস্তিদার বা কংগ্রেসের অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়ের। আনিসুর বিধায়ক, বাকি দু’জন সাংসদ।
জনসভায় দাঁড়িয়ে রাজ্যের মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে নিম্ন স্তরের, কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেছেন ডোমকলের ওই বিধায়ক। দিল্লির ধর্ষণ কাণ্ডের প্রতিবাদে পথে নামা মহিলাদের প্রতি অমর্যাদাকর কটাক্ষ করেছেন জঙ্গিপুরের কংগ্রেস সাংসদ। আর বারাসতের তৃণমূল মহিলা সাংসদ জানিয়েছেন, পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ-কাণ্ড আদৌ ধর্ষণ নয়, ওই মেয়েটি ও তাঁর ‘খদ্দেরদের’ মধ্যে গোলমাল।
আনিসুর ও অভিজিৎ প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছেন। পার্ক স্ট্রিটের নিগৃহীতা সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্যের পরেও কাকলি বা তাঁর দলের পক্ষে ক্ষমা চাওয়ার খবর নেই। তবে ফোনে এক যুবককে খুনের হুমকি দিয়ে ক্ষমা চাইতে দেরি করেননি সদ্য তৃণমূলে এসে মন্ত্রী হওয়া হুমায়ুন কবীর।
ক্ষমার আড়ালে অশালীনতা ঢাকা পড়ে না। ২০১২ কলঙ্কের কালি বারবার গায়ে মাখল। এঁরাই সমাজের মুখ, জনপ্রতিনিধি। বর্ষশেষের যন্ত্রণা।
অশোক সেন দময়ন্তী সেন অনির্বাণ লাহিড়ি
২০১৩-র যাত্রায় এঁরাই আমাদের সঙ্গী। এঁদের নিয়েই এগোতে হবে ভবিষ্যতের পথে। ভূতের ভবিষ্যৎ!
ভূত মানে অতীত। যা পিছন দিকে টানে। ভূত মানে আতঙ্কও। এগোতে গেলেই ভয় দেখায়। ২০১২ দুটোই করতে পেরেছে। রাজনীতি, শিল্প, শিক্ষা, সংস্কৃতি সবেতেই এখন ভূতেদের জয়জয়কার।
রাজনীতিতে ভূতের বোঝা সবচেয়ে বেশি বয়ে বেড়াচ্ছে সিপিএম। শাসক থেকে বিরোধী হয়েও নিজেকে বদলানোর কোনও ছাপ এ বছরেও তারা রাখতে পারে নি। মান্ধাতার আমলের ধ্যানধারণাতেই পাক খাচ্ছে তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। রাজ্যের উন্নয়নের চেয়ে ‘সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের’ বিরুদ্ধে আন্দোলন সেখানে বেশি গুরুত্ব পায়। শিল্পের জন্য জমি কিংবা খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগের বিরোধিতায় তৃণমূল সরকারের সঙ্গে তাদের কোনও নীতিগত ফারাক নেই। এমনকী, সরকার ও শাসক দল তোষণের রাজনীতি করলেও ভোট হারানোর ভয়ে চুপ করে থাকাই শ্রেয় মনে করেছে সিপিএম। সব মিলিয়ে তাদের হাল এখন, না ঘর কা-না ঘাট কা।
রাজ্য কংগ্রেসের কথা যত কম বলা যায়, ততই ভাল। রাজ্যের স্বার্থরক্ষার যুক্তি তুলে কেন্দ্রে ইউপিএ জোট ও সরকার থেকে তৃণমূল বেরিয়ে আসার পরে রাজ্যে তৃণমূল জোটের সরকার ছেড়েছে কংগ্রেস। বিধানসভাতেও তারা এখন বিরোধী দল। এ বছরের রাজনীতিতে এগুলি অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কিন্তু তৃণমূলের ছেড়ে আসা মন্ত্রীদের জায়গায় অধীর চৌধুরী-দীপা দাশমুন্সিদের মতো কয়েক জন নতুন মন্ত্রী হওয়ার বাইরে রাজ্য কংগ্রেসের দলীয় ভূমিকা একই রকম দুর্বল। পঞ্চায়েত নির্বাচন দরজায়। এখনও প্রদেশ কংগ্রেসের মাথায় কোনও শক্তপোক্ত, ফুল-টাইম নেতা খুঁজে পাওয়া গেল না। সরকারি জোটে থাকার সময়ে দল ছিল তৃণমূলের ছত্রছায়ায়। নিজেদের সংগঠন বলতে কিছুই প্রায় ছিল না। বিরোধী বেঞ্চে বসেও দলের সাংগঠনিক চেহারা ফেরানোর কোনও লক্ষণ এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না।
এই ফাঁক দিয়ে কিছুটা মাথা তোলার চেষ্টা করেছে বিজেপি। তাদের সভা-সমিতিতে লোকসমাগম হচ্ছে। ফল কী দাঁড়াবে, সে বিচার ভবিষ্যতের। কিন্তু ২০১২-র রাজ্য রাজনীতিতে বিজেপি একেবারে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে নেই।
২০১২-তে জাতীয় রাজনীতির অঙ্গনে তৃণমূল অবশ্য কিছুটা একা হয়ে গেল। কেন্দ্রে সরকার ও জোট ছেড়ে আসা তৃণমূলের সঙ্গে অন্য কার কী বোঝাপড়া হবে, সেটা এখনও খুব স্পষ্ট নয়। এই অবস্থায় রাজ্যের সঙ্গে কেন্দ্রের সম্পর্কের অবনতি মহাকরণকে কী ভাবে, কতটা চাপে ফেলতে পারে, সেই চিন্তা থেকেই যায়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি তাঁর পথ থেকে সরবেন না। রাজ্যের উন্নয়ন ও শিল্পায়নের লম্বা তালিকাও এই বছরেই বারকয়েক পেশ করেছেন তিনি।
কিন্তু ঘটনা হল, নেই-শিল্পের যে অতীত ৩৪ বছর ধরে এ রাজ্যের কপালে লেপ্টে ছিল, পরিবর্তনের ঝড়েও সেই ভূত ঘাড় থেকে নামেনি। শিল্প তাড়ানো সিঙ্গুর-ভূতের সঙ্গে এ বছরের বড় আমদানি এবিজি-তাড়ানো আর এক ভূত। ধুঁকছে হলদিয়া বন্দর। একেবারে মানানসই জুটি। আছে আরও হাজার ভূতের খেলা দুর্গাপুরে, আসানসোলে, কাটোয়ায় কিংবা রাজারহাটের সিন্ডিকেটে। চলতি বছরটা বারবার ভূতেদের আশ্বাস দিয়েছে, এই বঙ্গ তাদের নিরাপদ আশ্রয়। এখানে কেউ তাদের পায়ের নীচের জমি কাড়তে পারবে না।
কতিপয় সরলমতি মনুষ্য ২০১১-তে দাঁড়িয়ে ভাবতে শুরু করেছিলেন অন্তত শিক্ষার অঙ্গনে ভূতের নৃত্য এ বার বন্ধ হবে, নতুন আইন করে এখানকার ভূতেদের ধরে হাঁড়িতে বন্ধ করার রাস্তা প্রস্তুত। ভূতেরা সেই ভাবনাতেও ছাই ফেলে একের পর এক ঘটনায় নিজেদের ধারাবাহিক সাফল্যের প্রমাণ দিয়েছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়িয়ে স্কুলের পাশ-ফেল পরীক্ষাতেও এই বছরে তারা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে তাদের ভবিষ্যৎ।
বিশ্ববিদ্যার ক্ষেত্রকে দলতন্ত্রের কবলমুক্ত রাখার জন্য অনিলায়নের ভূত তাড়াতে গত বছর তৈরি হয়েছিল নতুন আইন। তাতে বিশ্ববিদ্যালয়কে মুক্ত করার কিছুটা চেষ্টা দেখা গেলেও কলেজগুলির পরিচালন কমিটিতে ভূতপূর্ব অবস্থাই বর্তমান। ফলে বিদ্যাস্থানে ভয়ও যথাপূর্বম্। কখনও রায়গঞ্জের কলেজে, কখনও ভাঙড়ে, কখনও ডায়মন্ড হারবারে, কখনও বা অন্য কোথাও ‘ছেলেমানুষ’ নামের ভূতেরা তাদের সগর্ব উপস্থিতি জানিয়েই চলেছে।
উপরন্তু বল-ভরসা পেয়ে ভূতেরা এখন স্কুলেও দাপিয়ে বেড়ায়। শিক্ষাকে তৃণমূল স্তরে পৌঁছে দিতে ফেল-করাদের পাশ করানোর দাবি তোলে। সন্তোষপুর, বেহালা, রানাঘাট, এমন কত দৃষ্টান্ত হাতের কাছেই।
ভূতের মতোই বাড়বাড়ন্ত মশাদের। সেই কবে গুপ্তকবি মশা-মাছি নিয়ে কলকাতায় কাল কাটানোর কথা শুনিয়েছিলেন। ডেঙ্গিতে ভর করে এই বছর গোটা গরমকাল মশারা কলকাতায় রাজ করে গেল। সৌজন্য: পুরসভা। সময়ে ঘুম না ভাঙার অতীত ঐতিহ্যকে মর্যাদা দিয়েছেন পুরকর্তারা। ডেঙ্গি তাই ভূতের মতো তাড়িয়ে বেড়ালো নাগরিকদের। শহরের এই দশা সাম্প্রতিক কালে হয়নি।
মশার মতোই আরও এক হুলে আক্রান্ত শহর। ত্রিফলা আলো। কলকাতাকে সাজানোর লক্ষ্যে বসানো এই আলোর নীচে যে এত অন্ধকার, এত ভূতের বাসা তা সামনে আসতে শুরু করেছে।
মহিলাদের শ্লীলতাহানি বা ধর্ষণের মতো ঘটনায় যে সব ভূতের দিকে অভিযোগের আঙুল ওঠে, তারা অবশ্য একটু ভিন্ন গোত্রের। তাদের ছোঁয়া গেলেও ধরার অনেক হ্যাপা। কারণ নিগৃহীতা মহিলার অভিযোগ যে ‘সটও ফেলেন, ভূতের বরে তাঁকে চলে যেতে হয় অনেক দূরে। প্রায় লোকচক্ষুর আড়ালে। ২০১২-র ফেব্রুয়ারিতে পার্ক স্ট্রিট কাণ্ড এবং সেই ঘটনাকে ধর্ষণ বলে চিহ্নিত করার পরেই লালবাজার থেকে তৎকালীন গোয়েন্দা-কর্তা দময়ন্তী সেনের চকিত বদলি এটাই দেখাল। বছর ঘুরতে চলল, আজও ওই অপরাধের চার্জ গঠন করা যায়নি। মূল অভিযুক্ত আজও অধরা। সবই চেনা ভূতের খেলা! ভূতেরা এ ভাবেই ফিরে ফিরে আসছে।
সিনেমাতেও তা-ই। ভূত এ বার বিগ হিট! অনীক দত্তের ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ থেকে সন্দীপ রায়ের ‘যেখানে ভূতের ভয়’ সিনেমা হল হাউসফুল। স্টার নয়, ভূত দেখতে ভিড়।
তবু এই ভূতের রাজ্যেও ভবিষ্যতের দিকে তাকানোর মতো কিছু সঞ্চয় আছে বাঙালির ঝুলিতে। আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাঙালি মেধার স্বীকৃতি এখনও পুরোপুরি অতীত হয়ে যায়নি। বিশেষত বিজ্ঞানে। কোথাও তাঁদের সাফল্যের স্বীকৃতি এসেছে ব্যক্তিগত গবেষণা থেকে, কোথাও বাঙালি বিজ্ঞানীদের দল কাজ করেছেন।
পদার্থবিজ্ঞানী অশোক সেন এঁদের অন্যতম। ইলাহাবাদে হরিশ্চন্দ্র রিসার্চ ইন্সটিটিউটের এই গবেষক-অধ্যাপক স্ট্রিং তত্ত্ব নিয়ে তাঁর কাজের স্বীকৃতিতে এই বছর ‘ফান্ডামেন্টাল ফিজিক্স অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছেন। দুর্ঘটনার স্মৃতি বারবার ফিরে আসার অসুখ আছে যাঁদের, তাঁদের চিকিৎসায় আলোকপাত করে এক সময়োপযোগী গবেষণার কৃতিত্ব অর্জন করেছেন বেঙ্গালুরুর ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োলজিকাল সায়েন্সেস-এর বিজ্ঞানী সুমন্ত্র চট্টোপাধ্যায়। কোষ-জীববিদ্যায় নতুন দিকের সন্ধান দিয়েছেন টাটা ইন্সটিটিউটের বিজ্ঞানী রূপ মল্লিক। মস্তিষ্কের কোষে কী ভাবে অঙ্কের জটিল হিসেবনিকেশ হয়, তার হদিশ মিলেছে এমআইটি-র বিজ্ঞানী মৃগাঙ্ক শূরের গবেষণায়। এঁরা কেউ অবশ্য কলকাতায় বসে কাজ করেন না। তবে জেনিভার সার্ন-এ ‘ঈশ্বর কণা’ নিয়ে গবেষণাতে কলকাতার সাহা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক সুনন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে কাজ করেছেন ইন্সটিটিউটের আরও তিন বাঙালি সুবীর সরকার, সুচন্দ্রা দত্ত ও সাত্যকি ভট্টাচার্য। কলকাতা সেই কাজের কিছুটা শরিক।
বাঙালি মগজ ছাপ রাখতে পেরেছে মঙ্গল-অভিযানেও। অমিতাভ ঘোষ এবং অনিতা সেনগুপ্ত। মঙ্গলে ভূতাত্ত্বিক গবেষণার সঙ্গে সক্রিয় ভাবে জড়িত নাসা-র বিজ্ঞানী অমিতাভ। জন্মসূত্রে বঙ্গতনয়া অনিতা যুক্ত ছিলেন মঙ্গল অভিযানের মহাকাশযান কিউরিওসিটি-র অবতরণের কাজে। উল্লেখে থাকবেন কৌশিক বসু। ভারত সরকারের অর্থনৈতিক উপদেষ্টার পদ থেকে তিনি বিশ্বব্যাঙ্কের চিফ ইকনমিস্ট হয়েছেন এ বছরেই।
নয় নয় করে খেলার বিশ্বেও বাঙালি একেবারে হারিয়ে যায়নি। ক্রিকেটে পরপর ছয় বলে ছ’টা ছয় মারার মতোই এক বিরল ঘটনা এ বার ঘটিয়ে ফেলেছেন বাঙালি গল্ফ-খেলোয়াড় অনির্বাণ লাহিড়ি। গত জুলাইতে ল্যাঙ্কাশায়ারে ব্রিটিশ ওপেনের তৃতীয় রাউন্ডে ‘হোল ইন ওয়ান’ করে গল্ফ দুনিয়াতে সাড়া ফেলে দিয়েছেন তিনি। অল্পের জন্য ব্রোঞ্জ থেকে বঞ্চিত হলেও লন্ডন অলিম্পিকে বন্দুকবাজ জয়দীপ কর্মকার মুখ রেখেছেন বাংলার। অনেক বাধার সঙ্গে লড়তে হয়েছে তাঁকে। তাই এই কুর্নিশটুকু তাঁর প্রাপ্য।
তাই বলে কি ভূতেরা বাঙালির ময়দান ছেড়েছে? না। উজ্জ্বল ভবিষ্যতের এমন ঠিকানা ছেড়ে তারা যাবে কেন! খেলার মাঠও এখানে তেনাদেরই কবলে। মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের ডার্বি ম্যাচে রণক্ষেত্র যুবভারতী তার টাটকা প্রমাণ।
ভূতের রাজা-রানির শুভেচ্ছা মাথায় নিয়ে বাঙালি রাত পোহালে ২০১৩-তে পা রাখবে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.