মোমবাতি মিছিল হয়নি। কর্মকর্তাদের পদত্যাগ চেয়ে যে বিক্ষোভটা রবিবার বিকেলে মোহনবাগান তাঁবুর সামনে হল, তা নিতান্তই নিরামিষ। তীব্র ক্ষোভ আছে, তাতে গনগনে আগুন নেই। পাহারায় থাকা পুলিশ কর্মীদের সঙ্গে সামান্য কথা-কাটাকাটি। কর্তারা যে যাঁর বাড়িতে অথবা বিদেশে। সামনে পুলিশকে পেয়ে ক্ষোভ জানালেন ওঁরা।
আকাশবাণীর উল্টো দিকে গোষ্ঠ পালের বল পায়ে ঝুঁকে থাকা মূর্তিটাও কি আরও ঝুঁকে পড়েছে, প্রিয় ক্লাবের দুর্দশায়? ময়দানের একমাত্র ফুটবলারের মূর্তির নীচে টুটু-অঞ্জন-সৃঞ্জয়-দেবাশিসের পদত্যাগ এবং ফেডারেশনের কাছে সিদ্ধান্ত পূনর্বিবেচনার দাবির পোস্টার হাতে সই সংগ্রহ করেছিলেন ঝকঝকে একদল যুবক। দেখে মনে হচ্ছিল, পাড়ায় পাড়ায় নির্বাসনের কলঙ্ক মাথায় নিয়ে মুখ লুকিয়ে ঘুরে বেড়ানো অসংখ্য মোহনবাগান সদস্য-সমর্থকের এক একটা মুখ।
দিল্লি ধর্ষণ কাণ্ডের পর চোদ্দো দিন কেটে গিয়েছে। বিক্ষোভ কমেনি। ক্ষোভের বেড়ে যাওয়া আগুন কমাতে রেড অ্যালার্ট জারি করতে হয়েছে সরকারকে। প্রেক্ষিত আলাদা, কিন্তু মাত্র দু’বছর পর যে ক্লাব ১২৫ বছর পূর্ণ করবে, তার সবথেকে লজ্জাজনক ঘটনার পর মাত্র একদিনেই ক্ষোভ নিভু নিভু। ডার্বি ম্যাচে বিরতিতে দল তুলে নিয়ে ক্লাবকে নির্বাসনে পাঠানো কর্তারা জানেন, কলকাতা কখনই দিল্লি হবে না। তা সে যে ভাবেই কালিমালিপ্ত হোক মোহনবাগান! আজ সোমবার ফেডারেশনের কার্যকর কমিটির কাছে শাস্তি কমানোর আবেদন করছেন মোহনবাগান কর্তারা। হয়তো শাস্তি তাতে কিছু কমবে। কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামের আলো-মাখা ঐতিহ্যের মোহনবাগানের গায়ে যে কালি লেগে গেল সেটা কি মুছবে?
“মোটেই না। সম্মানটাই তো ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেল,” বলছিলেন রাজ্যের প্রাক্তন রাজ্যপাল শ্যামল সেন। যাঁর বাড়িতে মোহনবাগানের বেড়ে ওঠা, সেই মানুষটির পরের কথাগুলো শুনে মনে হল অসংখ্য মোহনবাগানির মনের কথা। “আমাদের ক্লাবের সংস্কৃতিটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছে গত কয়েক বছরে। সৌজন্যবোধটাই ছিল আমাদের ক্লাবের সম্পদ। কিন্তু এখন যাঁরা ক্লাব চালাচ্ছেন তাদের ঔদ্ধত্য দেখে কষ্ট পাই। পুলিশ দিয়ে মেম্বার-সাপোর্টারদের মারছে। আরে ওরা না থাকলে ক্লাবের অস্তিত্ব কোথায়? ক্লাব তো কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়?” |
হতাশা বেরিয়ে আসে ক্লাব-অন্ত প্রাণ মানুষটির মুখ থেকে। উত্তর কলকাতার বনেদি সেন বাড়ি থেকে সল্টলেকের ফ্ল্যাট। আভা মান্নার মৌনতা জানিয়ে দিয়ে যায় যেন আরও হতাশা। “সব কাগজে পড়েছি। নিজে অসুস্থ। কী বলব। সবাই সব দেখছে। আমার কিছু বলার নেই। ছেড়ে দিন ভাই,” ফোন নামিয়ে বিতর্ক থেকে দূরে চলে যেতে চান মোহনবাগানের সঙ্গে লেপ্টে থাকা নাম প্রবাদপ্রতিম শৈলেন মান্নার স্ত্রী।
হতাশা, ক্ষোভ সবই আছে। আছে যন্ত্রণা, বেদনাও। কিন্তু নিজের সম্মান বাঁচিয়ে দূরে সরে থাকা মনোভাবই মোহনবাগান নামক প্রতিষ্ঠানের সব থেকে বড় ক্ষতি করে দিয়েছে গত কয়েক বছরে। ক্লাবের সঙ্গে পঞ্চাশ বছরেরও বেশি জড়িত এক প্রবীণ সদস্য আক্ষেপ করে বলছিলেন, “আমাদের ক্লাব প্রশাসনের সঙ্গে সি পি এমের ৩৪ বছরের শাসনের তুলনা করতে পারেন। ক্ষমতা দেখিয়ে সব কিছু পেতে চায়।” প্রায় বাইশ বছর ক্ষমতায় আছেন টুটু বসুর নেতৃত্বে বর্তমান শাসক গোষ্ঠী। তাদের আমলেই তিন বার আই লিগ জিতেছে মোহনবাগান। বহু বার ফেড কাপ পেয়েছে। কলকাতা লিগ, শিল্ডসহ অসংখ্য ট্রফি। ইস্টবেঙ্গলের কাছে পাঁচ গোলে হারের লজ্জা থেকে বেঁচেছেন মোহনবাগান সমর্থকরা টুটু-অঞ্জন-দেবাশিসদের সৌজন্যেই। মোহনবাগানরত্ন চালু করে চুনী-বদ্রুদের মতো প্রাক্তনদের সম্মান দিয়েছেন। এ সবই ঠিক।
আবার এটাও ঠিক বারবার নির্বাচন জিতে জিতে কোনও কিছুকেই এখন আর তোয়াক্কা করেন না কর্তারা। পেরেন্ট বডির অফিস ভাঙচুর করেন অনায়াসেই। আই এফ এ শিল্ড জয়ের শতবর্ষ পালন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। শুধু তাই নয়, জয়ের শতবর্ষ পূরণের বছরে শিল্ডই খেলেননি, চোটের কারণ দেখিয়ে। না খেলাটাই ইদানীং রেওয়াজ হয়ে গিয়েছে বাগানে। টোলগে ওজবেকে না ছাড়লে কলকাতা লিগের ম্যাচ খেলব না, শিল্ড খেলব না, এয়ারলাইন্সে না খেলে ট্রফি জিতবআই এফ এ বা অন্য সংস্থার মেরুদণ্ড নেই বলে এত দিন পার পেয়ে গিয়েছেন কর্তারা। এ বার কিন্তু সত্যি সত্যিই পালে বাঘ পড়েছে। ফেডারেশনে সারা ভারতের প্রতিনিধিরা রয়েছেন। তারা অন্যায় মানবেন কেন? আই লিগ টু-তে খেলার লজ্জাজনক পরিস্থিতি তাই মোহনবাগানের সামনে। ক্লাবের ঐতিহ্য বিরোধী এই সিদ্ধান্তগুলো নেওয়ার সময় মোহন-কর্তারা একবারও ভাবেননি কোটি কোটি সমর্থকের আবেগের কথা। মনের কথা। যে সমর্থকরা শনিবার পকেটের পয়সা খরচ করে এসে ক্লাব তাঁবুতে হাউ হাউ করে কেঁদেছেন। মাথা ঠুকেছেন। রক্তাক্ত হয়েছেন।
ইস্টবেঙ্গল আর মোহনবাগানের প্রশাসনের মধ্যে ফারাক একটাই, লাল-হলুদে দু’-তিনজন ক্ষমতাবান হলেও সব কিছু চলে আলোচনার ভিত্তিতে। মেপে-ঝুপে। মোহনবাগান চলে কিছুটা জমিদারি ঢং-এ। ধীরেন দে-র আমল থেকেই তা চলে আসছে। পরম্পরায় তা পেয়েছেন টুটু-অঞ্জনরা। ভাইস প্রেসিডেন্ট নিয়ে মোহনবাগানের কমিটির সদস্য ২৯ জন। ৯ ডিসেম্বরের ডার্বি ম্যাচে যুবভারতীতে হাজির ছিলেন ক’জন জানেনতিন জন! নিজেদের টিমের ম্যাচ দেখতেই তাদের আগ্রহ নেই। কমিটির সদস্যদের বেশির ভাগের কাছেই মোহনবাগান প্যাশন নয়, অলঙ্কার। মিটিংয়ে হাত তোলাই তাদের কাজ। যাঁরা সে দিন দল তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তাঁরা কেউ মাঠেই ছিলেন না। টিভিতে খেলা দেখছিলেন। বিরতিতে ফুটবল সচিব উত্তম সাহা যখন সচিব অঞ্জন মিত্রের নির্দেশ পেয়ে ম্যাচ কমিশনারের কাছে চিঠি নিয়ে যাচ্ছিলেন তখন তাঁর হাতটা কাঁপছিল। চূড়ান্ত অসহায় মনে হচ্ছিল। আশেপাশে কেউ নেই। পিছন পিছন দৌড়োচ্ছেন ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্র। সিদ্ধান্ত পূনর্বিবেচনার জন্য। কিন্তু উত্তমের কিছু করার ছিল না। তিনি তো বাহক মাত্র। ক্লাব চালান চার কর্তা। অন্যরা বাহক ছাড়া আর কী হবেন! সচিব অঞ্জন মিত্র শনিবারও বলেছেন, “১৬ অগস্ট হতে দিতে চাইনি। চাইনি মানুষ মারা যাক। নবির কিছু হলে কে দায়ী থাকত? অন্য ফুটবলাররা কেউ মারা গেলে কী হত?” তাঁর কথা তিনি বলেছেন। কিন্তু এটাই ঘটনা যদি নবির চোট অন্য ফুটবলারদের ভয়ার্তই করে, তা হলে ঘটনার পরই কেন টিম বেরিয়ে এল না? নবির চোট পাওয়ার পরও কেন দু’মিনিট খেলল করিম বেঞ্চারিফার টিম? ২০১৪-য় মোহনবাগানের নির্বাচন। বর্তমান কর্তাদের পকেটে যা ভোট তাতে তাঁরাই ক্ষমতায় আসবেন। কিন্তু যে কলঙ্ক ক্লাবের গায়ে চির দিনের জন্য ওঁরা লাগিয়ে দিলেন, নির্বাচন জিতে তা কিন্তু মোছা যাবে না। পাঁচ গোলের লজ্জা মোছা যায়, নির্বাসনের কলঙ্ক মুছবেন কী করে? |