এই ভারত সফরের শুরুটাই যে এমন মনখারাপ দিয়ে হবে, ভাবতে পারিনি।
তারিখটা পরিষ্কার মনে আছে। ২২ ডিসেম্বর। দিল্লিতে সবে পা দিয়েছি। আর দিয়েই শুনলাম, সচিন ওয়ান ডে ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়ে ফেলেছে। জানিয়ে দিয়েছে, ও ভারতের ওয়ান ডে জার্সি আর পরবে না। মনটা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল।
আসলে আমি সেই সৌভাগ্যবান সাংবাদিকদের একজন, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যে সচিনের অভিষেক দেখেছে। অবচেতনে কোথাও নিশ্চয়ই একটা ইচ্ছে লুকিয়ে ছিল যে, ওর অবসরের দিনেও আমি থাকব। সচিনের শেষ নিয়ে আমারও একটা লেখা থাকবে। ওর মতো ব্যাটসম্যান তো রোজ জন্মায় না। যাক গে, হল না। কী করা যাবে! তবে সচিনকে একটাই জিনিস জিজ্ঞেস করার আছে। যেতে চাইলে তো তুমি বিশ্বকাপ জিতেই চলে যেতে পারতে। কিন্তু তার পর খেললে যখন, পাকিস্তান সিরিজ দিয়ে শেষ করতে পারতে। তোমার মতো গ্রেট ব্যাটসম্যানের শেষটাও তা হলে রাজকীয় হত।
আজ চেন্নাইয়ের প্রেসবক্সে বসে সচিনকে খুব মিস করছিলাম। জুনায়েদ খানের সামনে ভারতীয় টপ অর্ডারের ধসে পড়া দেখে মনে হচ্ছিল, সচিনের প্রাসঙ্গিকতা এখনও হারায়নি ভারতীয় ক্রিকেট। ওকে এখনও দরকার। সচিন থাকলে কে বলতে পারে, ভারতের রানটা আরও একটু বেশি উঠত। তবে সেলাম ঠুকব মহেন্দ্র সিংহ ধোনিকে। বিশাখাপত্তনমে ওর একটা ১৪০ রানের ইনিংস দেখেছিলাম। কিন্তু শনিবারের সেঞ্চুরিটা অন্য মানের। অন্য মাত্রার। ভারতে আসার আগেই নানা জায়গা থেকে শুনছিলাম, ধোনি মারাত্মক চাপে আছে। ম্যাচের পর ম্যাচ হারছে। সচিনকে বাদ দেওয়া নিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে। তা সমালোচকদের আজ একদম চুপ করিয়ে দিল ধোনি। বিশ্বকাপ ফাইনালের ইনিংসের খুব কাছেই থাকবে ওর আজকের সেঞ্চুরি। ২৯-৫ থেকে টিমকে ২২৮-এ নিয়ে গেল একা। মিসবা যদিও ওর কাজ কিছুটা সহজ করে দিয়েছিল। ডিফেন্সিভ ফিল্ড সাজিয়ে। ওর ক্যাচটাও মিসবা ঠিকঠাক ধরতে পারলে ম্যাচ আরও আগে জিতে যায় পাকিস্তান। চলতি সফরে পাকিস্তানের পারফরম্যান্স কিন্তু পাকিস্তানিদেরও চমকে দিয়েছে। টি-টোয়েন্টি সিরিজের পর ওয়ান ডে-তেও ভারতকে ওদের দেশে এতটা চাপে রাখা যাবে, আমরা কেউই ভাবতে পারিনি। |
প্রেসবক্সে অনেকে আমাকে জিজ্ঞেস করছিলেন জুনায়েদকে নিয়ে। ওসামা বিন লাদেন কোথা থেকে ধরা পড়েছিল মনে আছে? জুনায়েদ কিন্তু সেই অ্যাবটাবাদের ছেলে। আর ওর সবচেয়ে বড় গুণ, ডান-হাতি ব্যাটসম্যানদের ক্ষেত্রে কী ভাবে বল ভিতরে আনতে হয়, খুব ভাল জানে। পাকিস্তানের আর পাঁচটা পেসার যে ভাবে উঠে আসে, ওর উঠে আসার গল্পটাও একই রকম। অনূর্ধ্ব-উনিশ খেলে প্রথম নজরে পড়ে। আমাদের দেশে এ রকম পেসার প্রচুর আছে। ওয়াহাব রিয়াজ খেলল না আজ। ও খেললেও কিন্তু ভারতকে ভাল রকম ভোগাত। মহম্মদ সামি তো দেড়শো কিলোমিটারে বল করেও বাইরে বসে আছে। আরও একটা জিনিস দেখে ভাল লাগল। ধোনির ওই ইনিংসের পর পুরো পাকিস্তান দলটাকে হাততালি দিতে দেখলাম। কামরান-ইশান্ত বিতর্ক নয়। এটাই তো চাই।
ব্যক্তিগত ভাবে দু’একটা ঘটনা ছাড়া, ভারত সফরের সঙ্গে বরাবরই আমার সুখস্মৃতি জড়িয়ে। ’৯৫ থেকে আসছি। বিশ্বাস করুন, আপনাদের দেশে এলে আমার আজ পর্যন্ত কখনও মনে হয়নি বিদেশে এসেছি। কখনও সামান্য অসুবিধাটুকু পর্যন্ত হতে দেননি কেউ। এ বারও দুর্দান্ত অভ্যর্থনা পেয়েছি। ভারতের সাংবাদিকবন্ধুরা নিয়মিত খোঁজ-খবর নিয়েছেন। কোথায় ভাল রেস্তোরাঁ খুলেছে, কোন হোটেলটা ভাল, কোথায় ভাল বলিউডি সিনেমার ডিভিডি পাওয়া যাবেসব কিছুর ঠিকানা নিমেষের মধ্যে হাতে চলে এসেছে। দিল্লির এক-একটা হোটেলে এমন মোগলাই খানা আছে, যা কি না লাহৌরেও পাওয়া যায় না। এ বারও দিল্লি নেমেই আগে সে সব জায়গায় ছুটেছি। আমি তো বলব, দু’দেশের ক্রিকেটীয় সম্পর্ককে এ বার নিয়মিত করে ফেলার সময় এসেছে। এন শ্রীনিবাসন অসাধারণ কাজ করেছেন, পাঁচ বছর পর সম্পর্কটাকে আবার চালু করে। আশা করব, সম্পর্কটা এরপর টিকে থাকবে।
শুধু দু’টো আফসোস যাবে না।
আজ পর্যন্ত ভারতে এসেছি দশ বার। কিন্তু এখনও তাজমহল দেখে উঠতে পারিনি! এ বারও হবে না, কারণ শহর-ভিত্তিক ভিসা পেয়েছি। তবু সেই দুঃখটা ভোলা যাবে। কিন্তু কসাভ-কাণ্ডের পর মুম্বইয়ের ব্যবহার ভুলতে পারব কি? গত বছরের ঘটনা। মুম্বই এসেছি। কসাবদের জঙ্গিহানার পর মহারাষ্ট্রের লোকজনের ব্যবহারও তখন কিছুটা বদলে যেত পাকিস্তানি শুনলে। দেখুন, দু’একটা জায়গা ছাড়া গোটা পাকিস্তান কিন্তু চরম নিন্দাই করেছে ওই ঘটনার। কিন্তু সে দিন হঠাৎ দেখলাম আমার হোটেল রুমে কয়েকজন পুলিশ। ব্যাগপত্র খুলে ফেলল, কী আছে দেখতে। ভীষণ খারাপ লেগেছিল। ওই একবারই ভারতে এসে মনে হয়েছিল, আমি পাকিস্তানি। |