গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে যখন সিঙ্গুরে জমি আন্দোলন চলছে তখন লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স-এর কফিঘরে এক অধ্যাপক মন্তব্য করেছিলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের মানুষের পুঞ্জীভূত অসন্তোষের এক সফল রাজনৈতিক কারবারি (successful political entrepreneur of the discontent of Bengal)। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সে দিন ব্যক্তির নামমাত্র ছিল না। ছিল একটি প্রতীক। একটি রাজনৈতিক পরিসর। চৌত্রিশ বছরের দীর্ঘ সি পি এম যুগের অসুখী মানুষের অসন্তোষকে মূলধন করে মমতা তখন পরিবর্তনের ঝড় তুলেছেন।
পশ্চিমবঙ্গে লড়াইয়ের এই সুযোগ তাঁর আগে অনেকেই পেয়েছেন। প্রণব মুখোপাধ্যায়, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি। ওঁরা পারেননি, তৃণমূলনেত্রী পেরেছেন। কেন? কীসের জোরে? কার্ল মার্ক্সকে এক বার প্রশ্ন করা হয়েছিল, তাঁর নিজের মতে তাঁর সবচেয়ে বড় গুণটি কী? মার্ক্স জবাব দেন: উদ্দেশ্যের একাগ্রতা (singleness of purpose)। রাজ্যের মার্ক্সবাদীরা এ কথা হাড়ে হাড়ে মানবেন যে, এই একটা ব্যাপারে মমতার সঙ্গে মার্ক্সের খুব মিল। তাঁরও এক দফা কর্মসূচি ছিল: সি পি এম হটাও। এই এক মন্ত্রের জোরেই হাওয়াই চটি আর সাধারণ সুতি শাড়ি পরা মমতা হয়েছিলেন ক্ষুব্ধ বাঙালির অবলম্বন। স্বপ্নের সওদাগর।
‘অ্যাচিভার’ বিরোধী নেত্রী রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর দেড় বছর অতিবাহিত। শহুরে মধ্যবিত্তের এক বড় অংশ ইতিমধ্যেই এই সরকারের নানা কাজে অখুশি। বিভ্রান্ত। অনুতপ্ত। মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেতৃত্ব এ জন্য অনেকাংশে সংবাদমাধ্যমকে দায়ী করছেন। কিন্তু সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা তো আসলে অনুঘটকের। কোনও দল বা নেতা যখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে, তখন তাঁর ঊর্ধ্বমুখী গণসম্মোহনকে সংবাদমাধ্যম চাইলেও টেনে নামাতে পারে না। আবার কেউ ভাটার মুখে পড়লে তাকে বিপরীতে নিয়ে যাওয়াও তার সাধ্য নয়। সংবাদমাধ্যম হয়তো কখনও কখনও উত্থান বা পতনকে কিঞ্চিৎ জোরদার করতে পারে, কিন্তু প্রকৃতির নিয়মের বাইরে যেতে পারে না। জনমানসের একটা অংশে মমতার সরকার সম্পর্কে মোহভঙ্গের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, এটা বাস্তব। |
সময় দরকার, সহিষ্ণুতাও। মুখ্য প্রশাসক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কলকাতা ২০১২ |
তার মানে এই নয়, সি পি এমের প্রতি হারানো বিশ্বাস রাজ্যবাসী ফিরে পেয়েছেন। রাজ্য কংগ্রেসের অবস্থাও তথৈবচ। কিন্তু সেটা মুখ্যমন্ত্রী বা তাঁর দলের পক্ষে সান্ত্বনার কারণ হতে পারে না। এত দ্রুত এত মানুষের মোহভঙ্গ কেন হল, সেটা তাঁদের ভাবতেই হবে। ঘটনা হল, সি পি এম-কে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য তৃণমূল কংগ্রেস বামপন্থীদের পরিত্যক্ত পথে হেঁটে এক স্তালিনতর সংস্কৃতির চৌকাঠে পৌঁছেছে। সেই অসহিষ্ণুতা সমানে চলছে। এটা খুবই আক্ষেপের কথা। ’৮৪ সাল থেকে ব্যক্তি মমতার সততা, নিষ্ঠা, দুর্জয় সাহস, জনপ্রিয়তা দেখেছি। কিন্তু ক্ষমতাসীন হওয়ার পর শাসক দলের কাছ থেকে গণদেবতা গণতান্ত্রিকতার যে বোধ প্রত্যাশা করে, তার অভাব ঘটছে। দলতন্ত্র অবসানের স্লোগান দিলেই তো হয় না। এটি গণতান্ত্রিক মানসিকতা প্রতিষ্ঠার প্রশ্ন। শাসককে স্থির করতে হবে, আমি সব্বাইকে নেতি নেতি করতে করতে আমার হিট লিস্ট দীর্ঘতর করব, না কি বর্জনের পন্থাকে সরিয়ে সকলকে গ্রহণ করব? সরকার কোনও বিশেষ দল বা সম্প্রদায় বা জাতিগোষ্ঠীর নয়, সকল মানুষের। রাজ্যের উন্নয়ন তথা নবজাগরণ তখনই সম্ভব হবে যখন সেটি সামগ্রিক জনসমাজের স্বার্থরক্ষায় রচিত হবে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সময় দিতে হবে। শুধু চোখে-আঙুল-দাদা হলে হবে না। মুখ্য প্রশাসকের ভূমিকায় তিনি নতুন, অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই শিখবেন। এমনও নয় যে, এ রাজ্যে দেড় বছরে কোনও ভাল কাজই হয়নি। কিন্তু সংকীর্ণ ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সেগুলিও চাপা পড়ে যাচ্ছে।
কিন্তু যে কোনও প্রশাসককে বলতে হয়: আমি অনেক কিছুই জানি না। বাইবেলের গল্পে রয়েছে চার ধরনের মানুষের কথা। এক ব্যক্তি যিনি জানেন না এবং জানেন তিনি জানেন না; তিনি সরল, তাঁকে শিক্ষা দিতে হবে। আর এক ব্যক্তি জানেন, কিন্তু জানেন তিনি জানেন না; তাঁকেও শিক্ষা দিতে হবে। তৃতীয় ব্যক্তি জানেন না কিন্তু জানেন যে তিনি জানেন; এই ব্যক্তি ভয়ংকর, তাঁকে এড়িয়ে চলা বিধেয়। চতুর্থ ব্যক্তি জানেন এবং জানেন তিনি জানেন; তিনি জ্ঞানী, তাঁকে অনুসরণ করতে হবে। আজকের বঙ্গসংস্কৃতিতে এক সবজান্তা মনোবৃত্তির প্রকাশ ঘটছে। রাজনীতিতেও তারই দাপট। এই অসুখের প্রতিকারের জন্য চাই স্থিত বুদ্ধি।
একটা সংশয় হয়। এই অসহিষ্ণুতা, সবাইকে, বিশেষ করে বিরোধীদেরও সঙ্গে নিয়ে চলার এই অক্ষমতা, এ কি তবে বাঙালির চরিত্রগত? নীরদচন্দ্র চৌধুরী লিখেছিলেন, বাংলায় বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাব যা-ই হোক না কেন, বাঙালি স্বভাবে শাক্ত। গাঁধীর সঙ্গে সুভাষের বিরোধকে নীরদবাবু নিরামিষ বৈষ্ণববাদীর সঙ্গে শাক্ত বিপ্লবীর সংঘাত হিসাবে দেখেছেন। বিনয় বাদল দীনেশ থেকে চারু মজুমদার, ষাটের দশকের বামপন্থী আর আজকের তৃণমূল কংগ্রেস, সর্বত্রই হিংসার ডি এন এ। কখনও ব্যক্ত, কখনও অব্যক্ত। কিছু দিন আগে তেহরানে গিয়েছিলাম। সেখানে মানুষ একদা বিপ্লব করে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে ইসলামিক শাসনের পত্তন ঘটায়। কিন্তু পুরনো রাজবাড়ি দেখাতে দেখাতে নবীন প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীরা বললেন: পরিবর্তন সর্বদাই ভাল, তখন এটাই ছিল সময়ের দাবি। রাজতন্ত্রের শোষণ চরমে উঠেছিল। কিন্তু নতুন শাসন পশ্চিমী উদারবাদের ঐতিহ্যকে সমূলে নাশ করেছে। রাশিয়ায় দেখেছি মানুষ আবার জারদের সমাধিতে মোমবাতি জ্বালাচ্ছেন। বলছেন, স্তালিনের সময় জারদের উপর সহিংস অত্যাচার ছিল অন্যায়। বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছিলেন, পরিবর্তন নিরপেক্ষ শব্দ। প্রয়োজন প্রগতি। প্রগতি শব্দটি ইতিবাচক। এই শব্দটিকে আমাদের দেশের বামপন্থীরা দীর্ঘ অপব্যবহারে অনেকখানি নষ্ট করেছেন। কিন্তু, সত্যিই, পরিবর্তন যদি সদর্থে প্রগতি আনতে না পারে, তবে তার মানে দাঁড়ায় একই জায়গায় ঘুরে চলা। বা, পিছন দিকে এগিয়ে যাওয়া। |