প্রবন্ধ ৩...
অন্ধকারে আশার আলো
‘আমরা দেশের দৌর্বল্যের লক্ষণ অনেক দেখেছি, কিন্তু যেখানে পেয়েছি তার প্রবলতার পরিচয় সেইখানেই আমাদের আশা প্রচ্ছন্ন ভূগর্ভে ভবিষ্যতের প্রতীক্ষা করছে।’—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

শোকে স্তব্ধ, লজ্জায় মুহ্যমান ঘোর অন্ধকারে ডুবে যেতে যেতে একটু আলোর আশায় বিহ্বল এ দিক ও দিক দেখছিলাম। সামনে রাখা বইটির খোলা পাতায় অকস্মাৎ চোখ পড়ল। দৈববাণীর মতো রবীন্দ্রনাথের স্বর ভেসে এল। সম্পূর্ণ অন্য পরিপ্রেক্ষিতে বলা কিছু শব্দবন্ধ মনে হল একান্ত প্রাসঙ্গিক। এই লজ্জাজনক ঘটনার মধ্যেও আমরা পরবর্তী প্রজন্মের প্রবলতার পরিচয় কি পাইনি? দীপ হাতে যে তরুণ মুখ দিল্লির রাজপথে দেখলাম, তারা কোনও বিতর্কে নেই। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, তারা ‘পরবর্তীকালের প্রজন্মে ইহার অগ্নিগর্ভ রূপ’।
ক’দিন ধরে বিজ্ঞজনদের ক্লান্তিকর মতামত, সূক্ষ্ম বিচার-বিশ্লেষণের মধ্যে প্রতিবাদী তারুণ্যের প্রবল প্রকাশ আমাদের একমাত্র আশার আলো। না, ভুল বললাম, একমাত্র নয়। যে তেইশ বছরের মেয়েটির জন্য আমরা শোকগ্রস্ত, সেই মেয়েটির মধ্যেও দেখেছি সেই ইচ্ছাশক্তির আর এক রূপ। দেহে মনে ক্ষতবিক্ষত হলেও চিকিৎসকেরা বলেছেন সে ছিল শান্ত ও সাহসী। তাঁদের কাছে সে তার লাঞ্ছনার বিবরণ দিতে ভীত হয়নি। অত্যাচারীদের জন্য চরম শাস্তি সে প্রার্থনা করেছে। মাকে সে বলেছিল এই পৃথিবীতে সে বেঁচে থাকতে চায়। আমরা তাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলাম না। তার জন্য আমরা শোক করব, কিন্তু সঙ্গে গর্বও বোধ করব।
এক অদ্ভুত হিংস্রতা গ্রাস করেছে আমাদের দেশকে, হয়তো সারা পৃথিবীকেই। ক’দিন আগে আমেরিকার ইস্কুলে সাতাশটি প্রাণ চলে গেল উন্মাদের গুলিতে। তার মধ্যে বেশির ভাগের বয়স পাঁচ বা ছয়। কী দোষ তারা করেছিল? হিংস্রতার আকস্মিক বহিঃপ্রকাশ যখন ঘটে, তখন সেই পরিস্থিতি কী ভাবে সামাল দিতে হয়, তা বোধহয় আমাদের অন্য দেশের কাছে শিখবার আছে। প্রথম যে দিন মেয়েটির খবর প্রকাশিত হয়েছিল, সে দিনই কিছু কড়া পদক্ষেপ নেওয়া, নেতৃস্থানীয়দের কাছে আশ্বাসের বাণী সাধারণ মানুষ প্রত্যাশা করেছিল।
তেমন কিছু ঘটল না। ঘটনার গুরুত্ব যেন কেউ অনুধাবন করতে পারলেন না। এ দেশে কত মিনিটে যেন এমন ঘটনা কতগুলো ঘটে থাকে? সেই সংখ্যার ভিড়ে ব্যাপারটা হারিয়ে যাবে, এমনই কি ভাবা হল?
কিন্তু যে দিন প্রতিবাদী তরুণেরা দখল নিল বিজয় চক, ধেয়ে গেল রাষ্ট্রপতি ভবনের চত্বরে, সে দিনও কি ঘটনার গুরুত্ব উপলব্ধি হল না? অন্তত চব্বিশ ঘণ্টা মনে হল, আমরা নেতৃত্বহীন দেশ, শাসনযন্ত্রের প্রকাশ জলকামান আর কাঁদানে গ্যাসে! দুটো সহমর্মিতার কথা অনেক বেশি কাজে দিত। রাষ্ট্রপতির চলনবলন বাঁধা থাকে প্রোটোকলে, আমরা জানি। তবুও একটুও যদি ভাঙতেন বাধা! প্রধানমন্ত্রী সাধারণত মৌনী থাকা পছন্দ করেন। অনেক রাতে, অনেক দেরিতে সনিয়া গাঁধীর তরফে সামান্য কিছু নাড়াচাড়া চোখে পড়ল। টু লিটল, টু লেট ইংরেজিতে বলে। আজকে দিল্লির যে চেহারা দেখছি তাতে ভীত বোধ করছি। এই ট্র্যাজিক মৃত্যুর ধাক্কাও আমরা ঠিকমত সামাল দিতে পারব তো? জনপথ রাজপথে আবেগের প্রকাশ রুদ্ধ করার সব ব্যবস্থা হয়েছে। রাস্তায় হেলমেটধারী রক্ষাকর্মীর ভিড়। আবেগের প্রকাশ মনের ভার লাঘব করে। পথ রুদ্ধ করে দিলে সাধারণ মানুষের মনে ‘এলিয়েনেশন’, দূরত্বের ভাব সৃষ্টি হয়। সেটা কাম্য নয়। আমার নিজের দেশের রাজধানী দেখে কেন মনে হচ্ছে যেন শত্রুকবলিত কোনও দেশে বাস করছি? এই একই রকম ছবি কোনও কোনও সময়ে দেশের বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে দেখেছি। সেখানে তার ফল ভাল হয়নি, মানুষ আরও খেপে গিয়েছেন। তার চাইতে আপ্রাণ মনে করার চেষ্টা করি স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে পার্লামেন্টে মধ্যরাতের অধিবেশন। সেন্ট্রাল হল-এ বাজছে মহাত্মা গাঁধী ও নেতাজি সুভাষচন্দ্রের কণ্ঠস্বর। নেহরুর কণ্ঠে ‘ভাগ্যের সঙ্গে অভিসার’-এর কথা। বিজয় চক-এ বাইরে তখন তরুণদের ভিড়। তারা এ আর রহমানের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গাইছে আর নাচছে মা তুঝে সালাম!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.