|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
চোখে চোখ রেখে কথা বলার স্পর্ধা |
স্বপন দাশগুপ্ত |
একটা বছর শেষ হলে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলা এখন প্রায় নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতি বছরের শেষেই মনে হয়, এই বছরটা একেবারে যাচ্ছেতাই ছিল, আমাদের জীবনে গুগ্ল আর উইকিপিডিয়া আসার পর এত খারাপ আর কোনও বছর কাটেনি। আর একটা অনুভূতিও অবশ্য হয়, শেয়ার বাজারের খেলোয়াড়রা যেমন রোজ ভাবেন কালকের দিনটা ভাল হবে, আমরাও প্রত্যেক পয়লা জানুয়ারিতে ভাবি, সামনের ৩৬৫টা দিন দুর্দান্ত ঝকঝক করবে।
লন্ডন থেকে একটা ছোট, কিন্তু উচ্চপ্রশংসিত পত্রিকা বেরোয়। ‘স্পেক্টেটর’। পত্রিকাটির গত সপ্তাহের সম্পাদকীয় প্রবন্ধে চোখ আটকে গেল, স্রোতের বিপরীতে মন্তব্য করার দুঃসাহস দেখেই বোধহয়। পত্রিকাটি লিখেছে, ‘দেখে হয়তো ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু ২০১২ সাল ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ বছর।’ কেন? ‘স্পেক্টেটর’ লিখেছে, ‘পৃথিবীর ইতিহাসে কখনও এত কম ক্ষুধা, এত কম অসুস্থতা আর এত বেশি সমৃদ্ধি দেখা যায়নি। পশ্চিম দুনিয়া অর্থনৈতিক সংকটে থাকলেও বেশির ভাগ উন্নয়নশীল দেশ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। মানুষ যে হারে দারিদ্রসীমার ওপরে উঠে আসছেন, ইতিহাসে কখনও তা দেখা যায়নি। আমরা একটা স্বর্ণযুগে বাঁচছি।’
জানি না, ভারতীয় অর্থনীতির ভাগ্য নির্ধারণ করেন যাঁরা, নয়াদিল্লির সেই দুই নীল পাগড়ি পরিহিত সর্দার এবং এক চেট্টিয়ার এই জাতীয় সবজান্তা সাংবাদিকতার পিছনে সময় নষ্ট করেন কি না। তবে তাঁরা জেনে আশ্বস্ত হবেন, ভারতে এখন যে ৫% আয়বৃদ্ধির ‘নতুন স্বাভাবিক’ হার হিসাবে স্বীকৃতি পাচ্ছে, পশ্চিমের দেশগুলোর কাছে তা বিলক্ষণ ঈর্ষার কারণ। সেখানে মানুষ ধরেই নিয়েছেন, জীবন এখন প্রাচ্যমুখী।
দুঃখের কথা হল, দেশের রাজনৈতিক মহল এই সুসংবাদের শরিক হতে রাজি নন। তাঁদের কাছে স্বর্ণযুগ মানে রামরাজ্য। সেই রাজ্যে কী যে ছিল, আর এখন কী কী হলে তবে সে জিনিস ফের প্রতিষ্ঠিত হতে পারে তা অবশ্য কেউ জানেন না। বরং, ‘মল সংস্কৃতি’ ও সংস্কৃতির মার্কিনায়নের বিরোধিতা করে, ‘কৃষকদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য ওয়ালমার্টের প্রয়োজন নেই’ ধুয়ো তুলে রাজনীতির মাঠে দাপিয়ে বেড়ানোই তাঁদের পছন্দ, অন্তত পশ্চিমবঙ্গে তো বটেই। কিন্তু ২০১২ সাল চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, ভারতের মানুষ আধুনিকতার প্রতীক নিয়ে সত্যিই মাথা ঘামান। এবং সেই প্রতীকের একটি হল উঁচু আয় বৃদ্ধির হার, যার মাধ্যমে ভারতের ‘সম্ভাবনা’ ভারতের বাস্তবে পরিণত হওয়ার পথে এগিয়ে যাবে। |
|
সংস্কার-উত্তর প্রজন্মের কণ্ঠস্বর। দিল্লির ধর্ষণ-কাণ্ডের প্রতিবাদে
ইন্ডিয়া গেট-এর সামনে তরুণদের বিক্ষোভ। ছবি: এ এফ পি |
১৯৯১-এর পর যাদের জন্ম, ভারতের সেই সংস্কার-উত্তর প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা ২০১২ সালেই সাবালক হল। তাদের বড় হয়ে ওঠার প্রতিফলন ঘটল দিল্লি-কেন্দ্রিক দুটি ঘটনায়। প্রথমটি অণ্ণা হজারের প্রেরণায় তৈরি হওয়া আন্দোলন। ভারতের তরুণ প্রজন্ম হঠাৎ মহাত্মা গাঁধীর নীতিনিষ্ঠ রাজনীতির মাহাত্ম্য বুঝতে পেরেছে বলে রাজনীতির প্রশ্রয়পুষ্ট দুর্নীতিগ্রস্তদের বিরুদ্ধে আবেগের বিস্ফোরণ ঘটল, এমন নয়। এই আন্দোলন জন্ম নিয়েছে এই বিশ্বাস থেকে যে, আয়বৃদ্ধি, কুশলতা ও সর্বোপরি মেধানির্ভর সমাজ নির্মাণের পথে দুর্নীতি একটা বাধা। অন্যের টাকায় উপরমহলের রাজনীতিকরা ফুলেফেঁপে উঠছেন, তীব্র বিরাগটা এই বাস্তবের বিরুদ্ধেই। অণ্ণা হজারের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যাঁরা জড়ো হয়েছিলেন, তাঁদের প্রতিবাদ ছিল মূলত সুবিধাবাদের রাজনীতির বিরুদ্ধে এবং বংশানুক্রমে শাসক-হওয়ার-জন্যই-জন্মানো রাজনীতিকরা যে ঔদ্ধত্য দেখিয়ে চলেছেন, তার বিরুদ্ধে।
দ্বিতীয় বিস্ফোরণটির আপাত-কারণ দিল্লির এক বাসে ২৩ বছরের তরুণীর পৈশাচিক ধর্ষণ। এ ক্ষেত্রেও যাঁরা ইন্ডিয়া গেট-এর সামনে বিক্ষোভ দেখাতে জড়ো হয়েছিলেন, তাঁদের ‘নিয়ে আসা’ হয়নি, তরুণ প্রজন্মের নাগরিকদের, মহিলাদের এই জমায়েত ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। আপাতবিচারে, এই বিক্ষোভ সেই পুরুষদের বিরুদ্ধে, যারা মনে করে, যে মেয়েরা রাতবিরেতে রাস্তায় বেরোয়, তারা আসলে ধর্ষিত হতেই চায়। ২০১২ সালেই কলকাতা, গুয়াহাটি বা দেশের আরও নানা অঞ্চলে ধর্ষণের বিরুদ্ধে যে ভাবে জনরোষ সংগঠিত হয়েছিল, দিল্লির ঘটনায় তারই প্রতিফলন ঘটে। কিন্তু অণ্ণার আন্দোলনের মতো এ ক্ষেত্রেও বিক্ষোভের আপাত-কারণকে ছাপিয়ে উঠেছিল তার অন্তর্নিহিত রাজনীতি রাজনৈতিক নেতারা যত ক্ষণ না বিপাকে পড়েন, তত ক্ষণ অবধি যে রাষ্ট্র সাধারণ মানুষকে নিয়ে মাথাই ঘামায় না, সেই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ।
২০১২ ভারতের রাজনৈতিক শ্রেণিকে একটা বিরাট বার্তা দিল: তাঁদের সঙ্গে ভারতের তরুণ প্রজন্মের দূরত্ব বাড়ছে, তাদের ক্ষোভের মুখে পড়ার সম্ভাবনাও বাড়ছে। এই প্রজন্ম তাদের মা-বাবাদের তুলনায় অনেক সচেতন, বিশ্বায়িত, উচ্চাকাঙ্ক্ষী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অতি সামান্য কার্টুন ফরওয়ার্ড করার পর এক অধ্যাপকের গ্রেফতারি হওয়াকে কেন্দ্র করে জনরোষের কথাই ধরুন। বা মহারাষ্ট্রের সেই দুই মেয়ের কথা, বাল ঠাকরের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে মুম্বইয়ের অচল হয়ে যাওয়া নিয়ে যাঁরা ফেসবুকে প্রশ্ন তুলেছিলেন। |
|
তাৎপর্যপূর্ণ হল, ব্যক্তিগত স্বাধীনতার গন্ডিকে আরও ছড়িয়ে দিতে চান, এমন ভারতীয়ের সংখ্যা এখন যথেষ্ট। তাঁরা ব্যক্তিগত স্বাধীনতা খর্ব করার যে-কোনও রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টারই বিরোধিতা করবেন। এই যে স্পর্ধিত প্রত্যয়ে নিজের স্বাধীনতা দাবি করা, একে আমাদের নতুন সমাজ আপন করে নিয়েছে সেই সমাজ, যেখানে সরকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকাই এত দিন মানুষের স্বাভাবিক ধর্ম হিসেবে বিবেচিত হত। এই পরিবর্তনটি প্রচলিত, ঘটেছে সংগঠিত রাজনীতির পরিসরের বাইরে। রাজনীতিকরা পড়েছেন বিপদে। মানুষ তাঁদের সামনে করজোড়ে, নতমস্তক দাঁড়াবে, এই দৃশ্যেই তাঁরা অভ্যস্ত ছিলেন। তরুণ প্রজন্ম হঠাৎ তাঁদের চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করছে, এই বাস্তবকে তাঁরা বুঝতেই পারছেন না।
তার মানে এই নয় যে, প্রচলিত গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে সরিয়ে সাধারণ মানুষের ক্ষমতার রাজনীতির বোধনের মুহূর্ত আসন্ন। ২০১২ সালে অনেকগুলি স্থানীয় নির্বাচন হয়েছে, সব ক’টিতেই ভোটদানের হার রীতিমত বেড়েছে। কোনও নতুন ঘরানার রাজনীতি তার আধিপত্য বিস্তার করেছে, এমনও নয়। উত্তরপ্রদেশে মানুষ এমন এক দলকে জিতিয়ে এনেছেন, যার ভাবমূর্তি বিশেষ উজ্জ্বল নয়। হিমাচল প্রদেশে যে দলটি জিতল, তার নেতা ৭৮ বছর বয়সী এক মানুষ, যাঁকে দুর্নীতির অভিযোগে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। গুজরাতে বি জি পি-র সরকার এই নিয়ে পর পর পাঁচ বার ক্ষমতায় এল।
সংশয়বাদীরা তাই বলতে পারেন, রাজনীতি-বিরোধী, স্বতঃস্ফূর্ত এই আন্দোলন অতি ক্ষণস্থায়ী, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ছিদ্রান্বেষী মিডিয়ার দ্বারা পরিচালিত। অরবিন্দ কেজরিওয়ালদের মতো ‘নতুন রাজনীতি’র ব্যাপারিদের সামাজিক ভিত্তি নিতান্ত সীমিত, এ অভিযোগও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কিন্তু ভারতের মূলধারার রাজনীতিকদের ভিত্তিতে নাড়া দিয়েছে যে নতুন রাজনীতি, তাকে অগ্রাহ্য করার একটা বিপদ আছে।
২০১২ সালে ভারতীয় অর্থনীতি খুব ভাল অবস্থায় ছিল না। শিল্প-উৎপাদন তেমন বাড়েনি, পশ্চিম দুনিয়ার আর্থিক ডামাডোলে পরিষেবা ক্ষেত্রের বৃদ্ধিও আটকে গিয়েছে। অর্থনীতি শ্লথ হওয়ায় দেশে সুযোগ কমেছে। সরকার অর্থনীতির স্বাস্থ্যোদ্ধারে ব্যর্থ, জীবন-মানেও তার প্রভাব পড়েছে। কিন্তু পশ্চিমে আর্থিক মন্দার অনিবার্য সঙ্গী হয়েছে তীব্র হতাশা, ভারতে প্রত্যাশা এখনও ঊর্ধ্বমুখী। সমাজের সব শ্রেণির মানুষ নিজেদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে এমন বদ্ধপরিকর, এটা প্রায় কখনওই ঘটেনি। কিছু মানুষের আশা জীবনযাত্রার মানের সেই উন্নতি সরকারি সাহায্যের মাধ্যমে আসবে। সে কারণেই কংগ্রেস আধার-এর মাধ্যমে সাহায্য দেওয়ার ব্যাপারে এমন মরিয়া হয়ে উঠেছে। অন্যরা অবশ্য সরকারের কাছে সামান্যই প্রত্যাশা করেন। তাঁরা নিজেদের উন্নতি নিজেদের চেষ্টাতেই করবেন। তাঁদের আশা, সরকার তাঁদের উন্নয়নের জন্য অনুকূল পরিবেশটুকু তৈরি করে দেবে।
আগামী দিনে হয়তো ভারতীয় রাজনীতির মূল কাজ হবে এই বিভিন্ন ধরনের প্রত্যাশার মধ্যে একটা সাযুজ্য আনা। হয়তো এই কারণেই ২০১২ সালের শেষ বড় ঘটনাটি অতিরিক্ত গুরুত্ব পাচ্ছে: কংগ্রেসের মনোনীত রাজপুত্র রাহুল গাঁধীর প্রতিস্পর্ধী হিসেবে নরেন্দ্র মোদীর উত্থান।
কয়েক বছর আগেও, যখন জাতপাত, ধর্ম, বংশপরিচয়ের জমিতে রাজনীতির ভিত পোক্ত ভাবে গাঁথা ছিল, এই উত্থানের গল্প অবিশ্বাস্য হত। কিন্তু গুজরাতের বাইরে মোদীর সমর্থনের ভিত্তি অন্য রকম। যে ভারতীয়দের বয়স এখনও পঁয়ত্রিশের নীচে, তাঁদের এক বড় অংশ আধুনিক প্রযুক্তিতে সিদ্ধহস্ত, প্রবল জাতীয়তাবাদী কিন্তু পশ্চিম-বিরোধিতার ঐতিহাসিক বোঝা বয়ে বেড়ান না, দেশের রাজনৈতিক শ্রেণিকে বিশেষ শ্রদ্ধার চোখে দেখেন না। তাঁদের কাছে মোদী আসলে এক জন তীব্র প্রতিষ্ঠান-বিরোধী মানুষ তিনি বিদ্রোহী, কিন্তু বিপ্লবী নন। এমন একটি দলের কর্মী হিসাবে নরেন্দ্র মোদীর রাজনৈতিক হাতেখড়ি হয়েছিল, কঠোর জাতীয়তাবাদই যার মূল আদর্শ, কিন্তু মাঝপথে কোথাও তিনি নিজের ভাবমূর্তি পাল্টে ফেলেছেন তাঁকে এখন তরুণ প্রজন্ম জঙ্গি আধুনিকতাবাদী হিসেবে চেনে। তিনি এখন এমন এক নায়ক, দেশের তরুণ প্রজন্মের আধুনিকতার ইচ্ছাকে, প্রযুক্তি-নির্ভর স্বপ্নকে এগিয়ে নিয়ে যেতে যিনি যে কোনও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লড়ে যেতে রাজি নিজের দলের সঙ্গেও।
রাহুল গাঁধীর সঙ্গে নরেন্দ্র মোদীর তুলনা করলে বলতে হয়, রাহুল এক উত্তরাধিকারমাত্র। আর মোদী, একটি ধারণা।
তবে, মোদী নামক ধারণাটিকে সফল হতে গেলে দেশের সর্বত্র, অর্থনীতির সব ধাপে থাকা মানুষের সঙ্গে একাত্ম হতে হবে। এখনও মোদী একটি বড়সড়, কিন্তু বিশেষ শ্রেণির প্রতীক, যাঁরা বড় মাপে ভাবেন, বড় মাপে স্বপ্ন দেখেন এবং সেই স্বপ্নের পথে রাজনীতি যে ভাবে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তাতে তিতিবিরক্ত। কিন্তু সেই ভারতের কী হবে, যেখানে স্বপ্নগুলো এখনও খুব ছোট, চরম বঞ্চনার চাপে ওষ্ঠাগতপ্রাণ? গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীকে নায়কের ভূমিকায় রেখে যদি আর একটা দাবাং তৈরি হয়, সেটা সুরাতে যে উন্মাদনা তৈরি করবে, পালামুতেও আবেগের সেই তীব্রতা জাগাতে পারবে? না কি, কোনও এক রাজবংশের শাসনকেই মানুষ নিয়তি বলে মেনে নেবে? ২০১২ সালের রাজনীতির চরিত্রলক্ষণ হল তার তুমুল অনিশ্চয়তা। আগামী বছর ভারত আবার নিশ্চয়তার খোঁজে পথ হাঁটবে। কিন্তু কে বলতে পারে, ২০১৪ বা ২০১৫ সালে যাঁরা বর্ষশেষের লেখা লিখবেন, তাঁদের কাছে হয়তো আজকের অনেক নতুন বিশ্বাসই নেহাত সাময়িক উচ্ছ্বাস বলে মনে হবে। ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি থেকে থেকেই ঘটনার অভিঘাতে পালটে যায়, পথভ্রষ্ট হয়, এ এক বড় মুশকিল বটে। |
|
|
|
|
|