আমরা পশ্চাতে ফিরিয়া দেখি কেন? পশ্চাদ্গামী হইবার জন্য নহে। যাহা চলিয়া গেল তাহা সম্বন্ধে আমাদের মনে স্বাভাবিক স্মৃতিকাতরতা থাকে। তাহার জন্যই এই পিছন পানে চাহিয়া থমকাইয়া যাওয়া। যখন বছর ঘুরিতেছে, নূতন বছর আসিতেছে, তখন তো ইহা বিশেষত অনিবার্য। কোথা হইতে আসে এই সিংহাবলোকন? হয়তো পুরাকালে ধর্মগুরুরা সাধারণ মানুষের মনে উৎসবাদী ভাবনা ঢুকাইয়া দিয়াছিলেন। এই জগতের দৈবনির্ধারিত আদি সৃষ্টিমুহূর্তটি যেন বড়ই মহান। আমরা তাহা হইতে ক্রমেই দূরে সরিয়া যাইতেছি। সে জন্যই অতীতের পানে, সেই আদি মূহূর্তের দিকে তাকাইবার প্রয়াস। কর্মফলে বিশ্বাসীরা বলিবেন, নিজেদের সংশোধনের জন্যই এই অতীতদর্শন জরুরি। বর্তমান তো অতীত কর্মফলের সমষ্টিমাত্র। বর্তমানের সুখদুঃখের কারণ তো অতীতের গর্ভেই নিহিত রহিয়াছে। অতীত না জানিলে চলে!
আধুনিক ইতিহাসবিদরা অবশ্য পৌরাণিক ও পুরাকালিক কর্মফলে বিশ্বাসী নহেন। ইতিহাস তাঁহাদের মতে ভবিষ্যতের পথেই অগ্রসর হয়। ইতিহাসের সরলরৈখিক বিশ্লেষণে যে ইতিহাসবিদদের রুচি নাই, তাঁহারাও স্বীকার করেন যে, ঘটনা কার্যকারণের উপর নির্ভরশীল। সপ্রমাণ সেই পরম্পরাকে ব্যক্ত করাই ইতিহাসবিদের কাজ। তাই অতীত খনন করিয়া ইতিহাসবিদ তাঁহার রস ও রসদ সংগ্রহে তৎপর। সাধারণ আধুনিক মানুষের অবশ্য এত কিছুর অবকাশ নাই, প্রয়োজনও নাই। ধর্ম কর্ম ইতিহাস, এত বালাই লইয়া তাঁহারা কী করিবেন? স্মৃতি তাঁহাদের নিকট সতত সুখের না হইতে পারে, কিন্তু সে তো তাঁহাদের পরম আদরের ধন। নিজস্ব। রবীন্দ্রনাথ ইহাকেই তো স্মৃতিলোক বলিয়া চিহ্নিত করিয়াছিলেন। মানবজীবন তো পরম্পরাবিহীন হইতে পারে না। স্মৃতিতেই তাহা পরস্পর যুক্ত। স্মৃতিকে লইয়াই অগ্রসর হইবে সভ্যতা। পুরাতন বৎসরের শেষ আর নূতন বৎসরের শুরু সেই অগ্রগতির এক নূতন সূচনালগ্ন। অতীত হইতে শিক্ষা লইয়াই সেই অগ্রগতি সম্ভব। সেখানেই স্মৃতির গুরুত্ব। স্মৃতিকে কীভাবে বহন করিব, কেন বহন করিব, তাহা সম্যক উপলব্ধি করা জরুরি। দিল্লিতে অত্যাচারিতা তরুণীর মর্মান্তিক মৃত্যু সেই উপলব্ধির এক নূতন দিগন্ত খুলিয়া দিয়াছে। সমাজের এক বড় অংশ এই একটি ঘটনায় কশাহত। এই আঘাতকে তুচ্ছ করিলে ভুল হইবে। ইহা যদি একটি সাময়িক এবং সহজে বিস্মরণীয় প্রতিক্রিয়ায় পর্যবসিত হয়, তাহা হইবে পরম দুর্ভাগ্যের। তরুণীটি চলিয়া গিয়াছেন, সেই ক্ষতি অ-পূরণীয়। কিন্তু তাঁহার কাহিনির স্মৃতি সচেতন ভাবে, সযত্নে বহন করিয়া চলা প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য। সেই স্মৃতিই ধারাবাহিক সতর্কতার জন্ম দিতে পারে, সৃষ্টি করিতে পারে ধারাবাহিক প্রতিরোধের সামর্থ্য। জনস্মৃতি দুর্বল বলিয়াই সেই ধারাবাহিকতার অভাব ঘটিয়া যায়, অন্যায় প্রশ্রয় পাইয়া চলে, প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, আন্দোলন, সকলই সাময়িক উত্তেজনার ফানুস উড়াইয়া বিলীন হইয়া যায়। ২০১৩ সেই ইতিহাস বদলাইতে পারিবে কি? |