২০১২ সাল পশ্চিমবঙ্গের ভাল যায় নাই। বৎসরের সূচনালগ্নে আশা ছিল, আগামী ৩৬৬ দিন ধরিয়া বুঝি সত্যই রাজ্যে পরিবর্তনের সুবাতাস বহিবে। প্রকৃত প্রস্তাবে, কিছুই বদলায় নাই। পশ্চিমবঙ্গে ২০১২ সালের মুখ কাহারা? উত্তরে অনেকগুলি নাম উঠিয়া আসিবে হলদিয়ায় শুভেন্দু অধিকারী, ভাঙড় কলেজে আরাবুল ইসলাম, রবীন্দ্রভারতীতে শঙ্কুদেব পণ্ডা, বারাসতে চিরঞ্জিৎ, কলিকাতায় মদন মিত্র। কাকলি ঘোষ দস্তিদার, আনিসুর রহমান, অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়। এবং, বৎসরের বারোটি মাস, ৩৬৬ দিন জুড়িয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বামপন্থীরা যে ভাবে রাজ্য চালাইতে অভ্যস্ত ছিলেন, তৃণমূল সরকার সেই পথ হইতে বিচ্যুত হয় নাই। ‘আমরা-উহারা’র বিভাজন হইতে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ঔদ্ধত্য, সবই পূর্ববৎ রহিয়াছে। দলের কর্মীদের অন্যায়ে চোখ বুজিয়া থাকিবার কু-অভ্যাসের সহিত যোগ হইয়াছে অসতর্ক মন্তব্যের বাড়াবাড়ি। কলেজে কলেজে তৃণমূলপন্থী ছাত্রদের তাণ্ডবকে মুখ্যমন্ত্রী ‘ছোট ছেলেদের ছোট ভুল’ বলিয়াছেন, ধর্ষণকে বলিয়াছেন ‘সাজানো ঘটনা’, হলদিয়ায় দলীয় তাণ্ডবের পর বলিয়াছেন ‘সব ঠিক আছে’। এই বৎসরই বিধানসভা রণক্ষেত্র হইয়াছে; তেহট্টে, লোবায় পুলিশের গুলিতে সাধারণ মানুষের মৃত্যু হইয়াছে; সিন্ডিকেটের রমরমা হইয়াছে; বাসভাড়া না বাড়ানো লইয়া কুনাট্যের চূড়ান্ত হইয়াছে। যাহা হয় নাই, সেই তালিকাটি অপেক্ষাকৃত ছোট শিল্পের জন্য জমির ব্যবস্থা হয় নাই, বিভিন্ন হাসপাতালে শিশুমৃত্যুর ঘটনা বন্ধ হয় নাই, ইমামদের ভাতা ব্যতীত সংখ্যালঘুদের উন্নয়নচিন্তা হয় নাই, শিক্ষাক্ষেত্রে দলতন্ত্রের শিকড়ে একটি আঘাতও পড়ে নাই। পশ্চিমবঙ্গ ভাল নাই।
২০১২ সালে পৃথিবী ধ্বংস হইয়া যাইবার কথা ছিল। হয় নাই। পশ্চিমবঙ্গও ধ্বংস হয় নাই। কোনটি বেশি আশ্চর্যের, সেই তর্ক থাক। পশ্চিমবঙ্গ আছে, এবং তাহার প্রধান প্রশাসক হিসাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও আছেন। স্বাভাবিক নিয়মে আরও অন্তত সাড়ে তিন বৎসর থাকিবার কথা। এই সময়কালে, এবং তাহার পরেও, পশ্চিমবঙ্গ কোন পথে যাইবে, তাহা আপাতত একটি বিষয়ের উপর অনেকখানি নির্ভর করিতেছে ২০১৩ সালে শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায় কোন পথে হাঁটিবেন। তিনি জেদ ত্যাগ করুন। মাটির সহিত তাঁহার যোগাযোগ ঈর্ষণীয়। তিনি কি শুনিতে পাইতেছেন না, গ্রামবাংলাতেও শিল্পের জন্য দাবি ক্রমে জোরালো হইতেছে? শিল্পই যে ভবিষ্যতের পথ, এই কথাটি রাজ্যের মানুষ ঠেকিয়া শিখিয়াছেন। মুখ্যমন্ত্রী জমির ব্যবস্থা করুন। শিল্পের অনুকূল পরিস্থিতি গড়িয়া তুলুন। দুর্বিনীত পারিষদদের নিয়ন্ত্রণ করুন। ২০১২-র ভুল পিছনে পড়িয়া থাকুক, নূতন বৎসরে তিনি নূতন মুখ্যমন্ত্রী হউন। অতীতে তিনি বহু বার হেলায় ক্ষমতা ত্যাগ করিয়াছেন। আজ কেন তিনি ভোটের স্বার্থকে রাজ্যের স্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থান দিবেন? সংকীর্ণ রাজনীতির সমীকরণ ত্যাগ করিয়া শিল্পের প্রশ্নে তিনি আন্তরিক হউন। পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাস তাঁহাকে স্মরণ করিবে।
নূতন বৎসরে আরও একটি কাজ তাঁহাকে করিতে হইবে বহুলাঞ্ছিত ‘পরিবর্তন’ শব্দটিকে সযত্নে ঝাড়িয়া-মুছিয়া তাহার সম্মান ফিরাইয়া দিতে হইবে। তাঁহাকে সত্যই পরিবর্তন আনিতে হইবে। মানসিকতায়, ভাবনাচিন্তায়, আচরণে। তিনি এই রাজ্যের নয় কোটি কুড়ি লক্ষ মানুষের মুখ্যমন্ত্রী। রাজধর্ম হইতে বিচ্যুত হইলে তাঁহার চলিবে কেন? তিনি স্মরণে রাখুন, দুষ্কৃতী সর্বত্রই আছে। তাঁহার দলেও আছে। তাহাদের দুষ্কৃতি প্রকাশ্যে আসিলে কেহ মুখ্যমন্ত্রীকে দায়ী করিবেন না। কাজেই সেই দুষ্কৃতীদের আড়াল করিবার প্রয়োজন নাই। প্রশাসনকে নিজের কাজ করিতে দিন। তাঁহার পূর্বসূরিরা মুষলপর্বে এই ধর্ম বিস্মৃত হইয়াছিলেন। তিনি সেই সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনুন। তাঁহারা বিরুদ্ধ মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন না। শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায় তাঁহার মুখ্যমন্ত্রিত্বের প্রথম দেড় বৎসরে সেই পথেই হাঁটিয়াছেন। এখানেও পরিবর্তন আসুক। সর্বোপরি, তিনি বাক্সংযম অভ্যাস করুন। তিনি যে ভাবে চলিবেন, তাঁহার দলের আগা-গোড়া যে সেই ভঙ্গিই অনুকরণ করিবে, তিনি তাহা বিলক্ষণ জানেন। তিনি পরিবর্তনের প্রতীক হউন। পশ্চিমবঙ্গ ২০১৩ সালে ভাল থাকুক। |