রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ২...
আমার প্রথম বই
সেটা ১৯৭৭ সাল। জানুয়ারির ১৪ তারিখে বেরলো আমার প্রথম বই। বইতে প্রকাশ তারিখ হিসেবে যদিও ছাপা ছিল ১ জানুয়ারি। কবিতার সংখ্যা ছিল আট। মোট পৃষ্ঠাসংখ্যা বারো। বই না বলে পুস্তিকা বলাই উচিত। কিন্তু সেটি ছিল দু’মলাটে বন্দি এমন কয়েকটি পাতা, যার ভিতরে শুধু আমার লেখাই ছাপা আছে। বাড়ি এনে পাতা উল্টে দেখছি যখন, মনের মধ্যে কেমন একটা ‘আমার বই’ ‘আমার বই’ ভাব জাগল।
এর আগে ছাপার পাতায় নিজের কবিতা কি দেখিনি? দেখেছি। অনেকই। তা হবে শ’দুয়েকের মতো। বিভিন্ন লিট্ল ম্যাগাজিনে। ‘দেশ’-এও একটা। কী ভাবে? মূলত ডাকে পাঠিয়েই। যেচেই পাঠাতাম। খামের ভিতর জবাবি খাম ভরে। কত লেখা যে ফেরত এসেছে! আবার ছাপাও তো হত। ফেরত এলে রাগ করতাম না। অন্য ম্যাগাজিনে পাঠিয়ে পরখ করতাম এটা এখানে চলবে কি না। এমনও হয়েছে দু’জায়গাতেই বাতিল। কবিতা ডাকে পাঠালেও পাণ্ডুলিপি ডাকে পাঠানোর কথা কখনও ভাবিনি। কারণ লেখা গুছোতে গিয়ে কূলকিনারা পেতাম না। রণে ভঙ্গ দিতাম। প্রায় পাণ্ডুলিপি করাই হয়নি। অন্তত ’৭৬ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত।
সে বার অক্টোবর মাসের শেষের দিকে খুব অসুস্থ হয়ে পড়লাম। খালি বমি পায়। কিছু খেতে পারি না। মাথা ঘোরে। সেই সঙ্গে থেকে থেকেই জ্বর। বাড়িতে বসে থাকি সারা ক্ষণ। মাঝে মাঝে বাড়ি থেকে তিন মিনিট দূরে মহকুমা লাইব্রেরির রিডিং রুমে গিয়ে বই পড়ি। রিডিং রুম ফাঁকা। আমি ছাড়া দ্বিতীয় পাঠক নেই। উত্তম দাশের ‘বাংলা সাহিত্যে সনেট’ বইটি পড়ে ঠিক করলাম আমিও সনেট লিখব। নিয়মকানুন শেখার চেষ্টা করলাম। এই সঙ্গে দীপ্তি ত্রিপাঠীর একটা বইও পড়েছি। হ্যাঁ, যে বইটা বিখ্যাত সেটাই। মাইকেল বা শক্তির চতুর্দশপদী পড়ে নয়, ইচ্ছেটা হল প্রবন্ধের বই পড়ে।
একা-একলা রিডিং রুমে বসেই প্রথম লেখাটা মনে হানা দিতে লাগল। প্রথম লাইনটা এল: ‘সম্পূর্ণ ক্ষুধার নীচে বালি আর সোরা আর গন্ধকের গৃহ...’। কী করব, কিছুই খেতে পারছি না তো তখন! খেলেই বমি। সঙ্গে ওই যে মাথা ঘোরা আর জ্বর। এ দিকে খাওয়া নিয়ে মায়ের বকাবকি। প্রথম স্তবকের চার লাইন, তার পর দ্বিতীয় স্তবকের চার লাইন এই আট লাইন পুরোপুরি মনে মনে দাঁড়িয়ে যাওয়ার পর, শেষ ছ’লাইনের জন্য বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলাম। হাঁটতে হাঁটতে ছ’লাইন। বাড়ি গিয়ে কাগজ-কলমে বসে কাটাকুটি করে গুছোতে লাগলাম সবটা।
সেই শুরু। তার পরের কয়েক দিন ধরে ব্যাপারটা চলল। ষোলো-সতেরোটা লেখা তৈরি হল। কিন্তু অনেকগুলোই চোদ্দো লাইনের বেশি যে! কোনওটা বা চোদ্দো লাইনে পৌঁছনোর তিন-চার লাইন আগেই থেমে গেল। টেনে তো আর বাড়াতে পারি না। সে কী করে হবে! শেষমেশ গোছগাছ করে সাতটা লেখা পাওয়া গেল যা চোদ্দো লাইনে এঁটেছে। আর যেগুলো বড় হয়ে গিয়েছিল, তাদের থেকে এক জনকে নিলাম। তার নামই ‘ক্রিসমাস’। বাকি সব বাদ। চির কাল আমার এমনই হয়েছে। এক ঝোঁকে কয়েক দিনের মধ্যে উপুড়ঝুপুড় অনেক কবিতা এসে পড়ে। তার পর আবার মাসের পর মাস ফাঁকা যায়। প্রথম থেকেই আমার প্রকৃতি এই রকম। এক ঝোঁকে এক গুচ্ছ।
ঝোঁক যখন কাটল, ৩১ ডিসেম্বর সন্ধেবেলা চন্দনকে পড়ে শোনালাম কবিতাগুলো। চন্দন মুখোপাধ্যায়। ভাল লিখত। ‘দেশ’-এ কবিতা-গল্পও বেরিয়েছে ওর। পুজোর ‘দেশ’-এও গল্প লিখেছে। বিমল কর পছন্দ করেছিলেন। কিন্তু গল্পের বই বেরোয় মৃত্যুর পর। চল্লিশ বছর বয়সে চলে যায়। আমি তখন তার সঙ্গী। চন্দন লেখাগুলো শুনে বলল, ‘এই আটটা লেখা এক সঙ্গে কোথাও দেওয়া ভাল।’ বলল, ‘ছোট্ট একটা বই হলে বেশ হয়। বীরেনবাবু যেমন বার করেন, পাতিরামে পাওয়া যায়।’ বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ছোট্ট ছোট্ট পুস্তিকা আমরা স্টল থেকে কিনতাম। প্রথম বই বার করার অনুপ্রেরণা বা পরিকল্পনা যা-ই বলা যাক, চন্দনের কাছেই পাই। সে বলে, কবিতায় ‘সৌত্রান্তিক’, ‘ব্যারাকুডা’ এ সব শব্দ কেন? তখন খুব বৌদ্ধ দর্শন পড়তাম তো, তাই ‘সৌত্রান্তিক’। আবার জেমস বন্ড-ও পড়তাম, সেখান থেকে ‘ব্যারাকুডা’। চন্দনই ছিল আমার প্রথম পাণ্ডুলিপির প্রথম ক্রিটিক।
আমার প্রথম প্রকাশক হলেন দেবদাস আচার্য। তাঁর কাছে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন সুবোধ সরকার। ওঁরা দু’জনেই কৃষ্ণনগরে থাকতেন। দেবদাস আচার্য আমাকে নিয়ে গেলেন ‘বঙ্গরত্ন মেশিন প্রেস’-এ। জানা গেল ছাপতে কত লাগবে। মোট ১৪৫ টাকা লেগেছিল। মা দিল টাকাটা। বলল, ‘ভাইকে তো একটা সাইকেল কিনে দিতে হল, তুমি না হয় বই-ই ছাপাও। তুমি তো আর সাইকেল চড়তে শিখলে না!’ দেবদাস আচার্যের কবিতাপত্রিকা ‘ভাইরাস’-এর নাম দেওয়া হল প্রকাশনা সংস্থা হিসেবে।
ক্রিসমাস ও শীতের
সনেটগুচ্ছ
দেবদাস আচার্য এবং সুবোধ সরকার খুব যত্ন করে প্রুফ দেখে দিয়েছিলেন। কাগজও পছন্দ করেছিলেন তাঁরাই। ম্যাপলিথো কাগজ। উৎসর্গ পাতায় লিখেছিলাম ‘মা-কে’। দেবদাসদা ও সুবোধ দু’জনেই খুব আনন্দ করেছিলেন সে যুগে, বইটা প্রকাশ পাওয়ায়। বইয়ের প্রথম ক্রেতা ছিলেন আজকের দিনের বিখ্যাত লেখক সুধীর চক্রবর্তী। তিনিও কৃষ্ণনগরের অধিবাসী। সন্ধেবেলা চাদর গায়ে জজকোর্টের সামনের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। যেতে যেতে কিনলেন। নিজের প্রথম বই প্রথম কপি বিক্রি হচ্ছে হাঁ করে দেখছি। সুবোধের হাত থেকে বইটি নিয়ে পাতা উলটে দাম দেখলেন। তার পর বুকপকেট থেকে একটা এক টাকার নোট বার করে দিয়ে চলে গেলেন। এক টাকার নোট তখনও ছিল, কয়েন আসেনি। হ্যাঁ, বইয়ের দাম ছিল এক টাকাই।
কভার ছিল নীল। অর্থাৎ নীল রঙের একটা পাতলা ধরনের কাগজ দিয়ে জ্যাকেট মতো করা হয়েছিল। ২২৫ কপি হাতে এসেছিল আমাদের। পাতিরামে দেওয়া হয়েছিল। আমি আবার হাঁটতে হাঁটতে পাতিরামের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে, এ-কাগজ ও-কাগজ দেখতে দেখতে যেন কিছু জানি-ই না এই ভাবে আমার বইটাও তুলে নিয়ে পাতা উলটে আবার রেখে দিলাম। কত কী করেছি! যদিও সেই ২২৫ কপির এক কপি-ও কাছে নেই এখন।
এ বই নিয়ে সে সময়ে বলবার মতো কোনও প্রতিক্রিয়া কোথাও পাইনি। ব্যক্তিগত কিছু অভিমত পেয়েছিলাম। যেমন মণীন্দ্র গুপ্তর একটি ইনল্যান্ড লেটার এসে পৌঁছয় আমার ঠিকানায়। তাতে কিছু মূল্যবান পরামর্শ ছিল। একটি পোস্টকার্ড দিয়েছিলেন প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত। অনেক দিন যত্ন করে রেখেছিলাম চিঠি দু’টি। এত বাড়ি বদলেছি জীবনে যে আজ আর তাদের খুঁজে পাই না।
আজ বুঝি, ওগুলো সনেট হয়নি। খামকা ‘শীতের সনেটগুচ্ছ’ কথাটা দিতে গেলাম কেন? পরেও অনেক সনেট লিখেছি সেসটিনা, ব্যালাড, ওড এ সবও চেষ্টা করেছি। কিন্তু আর কখনও কোনও ঘোষণায় যাইনি। কী যে জাহির করার লোভ পেয়ে বসল তখন!
আসলে মানুষ তো শুধু কতগুলো মিল লিখতে চায় না, মিলের কিছু বিন্যাসও লিখতে চায় না সে চায় একটা কবিতা লিখতে।
অবশ্য আজ এ সব মাথায় আসছে। কিন্তু তখন তো আমার বয়স বাইশ।
তখন তো আমার প্রথম বই। আজ শত চেষ্টা করলেও আমার প্রথম বই আর বেরোবে না!

সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.