রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ১...
বাঙালির ল্যাং
দস্থ মানুষকে অপদস্থ করায় বাঙালি তুখড় জাত। টেনে নামানোর খেলায় সে উপরে উঠেছে অনেক। যুগ-যুগ ধরেই তার এক হাতে কাঠি, অন্য হাতে চুনকালির ভাঁড়। বাঙালি পাবলিকের হতাশা ছিল, ইনসিকিয়োরিটি ছিল, কিন্তু সে সব ছাপিয়ে ছিল, আছেও, অপরকে হেয় করার বেসিক ইনস্টিংক্ট। বিশেষত, সেই জাতভাইকে, যে তার সঙ্গে এক প্ল্যাটফর্মে থেকেও আজ অনেকটা উপরে উঠে গিয়েছে। কে জানে কী করে, কপাল-জোর না ব্যাকডোর! আমি অধম মানলুম। কিন্তু ও ব্যাটা উত্তম সাজবে কেন? অতএব, টেনে নামাও। পিছনে লাগো। হ্যারাস করো।
ভারতচন্দ্র সেই কবে লিখেছিলেন ‘শিবের ভিক্ষা-যাত্রা’-র কথা
‘দূর হইতে শুনা যায় মহেশের শিঙ্গা।
শিব এল ব’লে ধায় এত রঙ্গচিঙ্গা।।
কেহ বলে নাচ দেখি গাল বাজাইয়া।
ছাই মাটী কেহ গায় দেয় ফেলাইয়া।।’

শিব আসছেন বুঝে চ্যাংড়া ছোঁড়াদের অতি আগ্রহ, ক্ষুধার্ত শিবকে ঘিরে তাদের শয়তানি, এ সবই টিপিক্যাল বাঙালি সাইকি। যে প্রবৃত্তি অপদস্থ করতে চেয়েছিল বিশ্বম্ভর মিশ্রকে। তিনি ‘বিশ্বম্ভর’ থাকলে কিছু আসত-যেত না, ‘চৈতন্যদেব’ হয়ে গিয়েই বাঙালিকে চাপে ফেললেন। সমাজের তথাকথিত নিচুতলার মানুষজন তাঁর ছাতার তলায় জায়গা পাওয়ায়, বিদ্রুপ করে বাংলা প্রবাদই তৈরি হয়ে গেল
‘মাছ খাই, মাংস খাই না, ধর্মে দিয়েছি মন
বৃদ্ধা বেশ্যা তপস্বিনী এসেছি বৃন্দাবন।’

জগাই-মাধাইয়ের আক্রমণ সেই মেগা-সিরিয়ালের একটা এপিসোড মাত্র। পরে ভুল বুঝে, জগাই-মাধাই না থাকলে নিমাইকে লোকে চিনত না: সাফাই গেয়ে বাঙালি প্রেমের মলম লাগাল। আত্মঘাতী বাঙালির কথা বলতে গিয়ে নীরদচন্দ্র চৌধুরী প্রেম-মলমটির সাইড-এফেক্ট কী মারাত্মক হতে পারে, দেখিয়েছেন। ‘চৈতন্যদেব সম্বন্ধে জনপ্রচলিত ধারণাটা একদিক হইতে ভুল। তিনি একমাত্র প্রেমের প্রচারক ছিলেন না; নাচুনে-কাঁদুনে তো ছিলেনই না।’ কিন্তু সে দিনের প্রাচীনপন্থী নিন্দুক পুরোহিতদের মতো আজকের বাঙালিও চৈতন্যকে ‘নাচে, কাঁদে, হাসে, গায় যৈছি মদমত্ত’ দেখতেই অভ্যেস করে ফেলেছে। সেই মধ্যযুগ থেকেই ঢলোঢলো ‘ন্যাকাচৈতন্য’ লেবেল সেঁটে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে তাঁর গায়ে। তকমা সাঁটার এই সুবিধেবাদী বাঙালি রাজনীতি কাজ করেছে রামকৃষ্ণের ক্ষেত্রেও। শিবনাথ শাস্ত্রীকে শেষ বার সাক্ষাতের সময় তিনি বলছেন ‘একবার ভেবে দেখ, সেই সর্বশক্তিমান ঈশ্বর গলার ক্যান্সারে মরতে বসেছে!/ অতঃপর উৎসাহী শিষ্যদের উদ্দেশে স্বগতোক্তি করিলেন বোকার অশেষ গুণ!’(‘রামকৃষ্ণ পরমহংস’/ ‘মহান পুরুষদের সান্নিধ্যে’/ শিবনাথ শাস্ত্রী)। এমন যাঁর বিবেচনা, জগৎসংসার সম্পর্কে আত্মোপলব্ধি, সেন্স অব হিউমার শত ফুল-বেলপাতা সত্ত্বেও সেই প্রকৃত সাধককে অ-স্বাভাবিকতার ফ্রেমে আঁটিয়ে ক্যালেন্ডারেই ঝুলিয়ে রাখতে চেয়েছে বাঙালি মাস্। যেমন শহিদ ক্ষুদিরামকে চেয়েছে ‘বাড় খাওয়া’-র সমার্থক করে জনমানসে বাঁচিয়ে রাখতে। সচেতনে নয়, হ্যাটা করার এই প্রবণতা মিশে গিয়েছে বাঙালির অবচেতনেই।
রবীন্দ্রনাথকেও বাঙালি ছেড়ে কথা বলেনি। ‘পায়রা কবি’ অভিধা জুড়েছে তাঁর সঙ্গে
উড়িস নে রে পায়রা কবি
খোপের ভিতর থাক ঢাকা।
তোর বকবকম আর ফোঁসফোঁসানি
তাও কবিত্বের ভাব মাখা!!

(কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ, রাহু)।
কখনও ধেয়ে এসেছে কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদের প্যারডি, কখনও সুরেশ সমাজপতি অ্যান্ড কোং-এর বিলো দ্য বেল্ট আক্রমণ। ১৯১৪ সালে, অর্থাৎ নোবেল পাওয়ার পরের বছর, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ম্যাট্রিকুলেশনের প্রশ্নপত্রে রবীন্দ্রনাথের ‘ছিন্নপত্র’ বইয়ের অংশ উদ্ধার করা হয়—
4. Rewrite in chaste and elegant Bengali:
যেদিন লিখবার ঝোঁক চাপে সেদিন হঠাৎ এত ভাব মনের মধ্যে এসে পড়ে যে দিশাহারা হয়ে যেতে হয়। এক সাথে কোকিল, পাপিয়া, হাঁস সকলগুলি ডাকতে আরম্ভ করে, আর বসন্ত, নিদাঘ, বর্ষা, শরৎ ছুটে এসে পড়ে। কতক যদি বা বলা হয় ত অনেক পড়ে থাকে। এতটা একটুখানি মানুষের মন পেরে উঠবে কেন?
রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের কর্তৃপক্ষ তখন পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের গদ্য ভাষাকে সাধু (chaste) বলিয়া স্বীকার করেন নাই।’ সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত তাঁর স্মৃতিকথায় অভিযোগ করেছিলেন, আশুতোষ মুখোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথকে হেয় করার জন্য এই কাজটি করেছিলেন, পরে আশুতোষ দীনেশচন্দ্র সেন ও সতীশচন্দ্র বিদ্যাভূষণের ওপর দোষ চাপান। তাঁরা এই মিথ্যা অপবাদ সহ্য করলেন কারণ আশুতোষ নাকি তাঁদের নানা সুযোগ সুবিধে দিয়ে বশীভূত করেন।
রামমোহন রায় সম্পর্কে পথে-পথে বাঙালি গেয়ে বেড়াত
‘সুরাই মেলের কুল,
বেটার বাড়ি খানাকুল,
বেটা সর্বনাশের মূল,
ওঁ তৎসৎ বলে বেটা বানিয়েছে স্কুল;
ও সে জেতের দফা করলে রফা
মজালে তিন কুল।’

রামমোহন-বিদ্বেষ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, যখন শোনা গেল, হিন্দু কলেজ তৈরির জন্য প্রস্তাবিত কমিটিতে রামমোহন আছেন, কলকাতার তাবৎ হিন্দু ভদ্দরলোক বেঁকে বসলেন: ‘তবে এই কালেজের সহিত আমাদের কোনও সম্পর্ক থাকিবে না।’ বড় একটা পরিকল্পনা বাধা পাবে বুঝে, রামমোহনই নিজেকে সরিয়ে নেন। শুধু কেচ্ছার নিরামিষ খেলাতেই থামেনি বাঙালি, তাঁর গাড়িতে দিনের পর দিন ইট পাথর কাদা ছুড়ে মেরেছে। তিনি মুচকি হেসে, গাড়ির দরজা টেনে বলেছেন, ‘কোচম্যান, হেঁকে যাও’। মদ্যপানের অভিযোগেও বিস্তর নিন্দেমন্দ শুনতে হয়েছে তাঁকে। বাধ্য হয়ে, রীতিমতো শাস্ত্র থেকে কোট করে-করে প্রমাণ দিতে হয়েছিল ওতে বিষ লাই! দু-এক পাত্তর খেলে কায়স্থের জাত যায় না! (‘কায়স্থের সহিত মদ্যপান বিষয়ক বিচার’/ রামমোহন রায়)।
বিবেকানন্দকে বাঙালি হেনস্থা করেছে স্রেফ চা-পানের অভিযোগে। চা খেলে শরীর-স্বাস্থ্য গোল্লায় যাবে তখন দিকে-দিকে এই প্রচার চালাচ্ছেন পণ্ডিতরা। কিন্তু বিবেকানন্দ হাতে তুলে নিলেন ধোঁয়া-ওঠা চায়ের পেয়ালা। পুরসভা তাঁর মঠের ট্যাক্স দিল বাড়িয়ে। বলল, এ তো নরেন দত্তর বাগানবাড়ি; এখানে দেদার চা-পান চলে! তবে তার চেয়ে অনেক বিষাক্ত অপমান সইতে হয়েছে, ‘কালাপানি’ পার হয়েছিলেন বলে। একে কায়স্থ, তায় ম্লেচ্ছদেশে গেছেন, ম্লেচ্ছদের সঙ্গে মিশেছেন, ম্লেচ্ছদের পাক করা ম্লেচ্ছ খাবার খেয়েছেন! তিনি সন্ন্যাসী হন কী করে? ‘বঙ্গবাসী’ কাগজ বাংলা ও হিন্দি সংস্করণে স্বামীজিকে নিয়ে নানা ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করতে থাকে। পরে স্টার থিয়েটারে মাসের পর মাস ‘অবতার’ নামে ব্যঙ্গ-নাটক অভিনীত হয়। তাঁর বিরুদ্ধে রাগ বাড়তে বাড়তে এমন জায়গায় গিয়েছিল, ১৮৯৭ সালের ২১ মার্চ বিবেকানন্দ যখন খেতড়ির মহারাজার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে যান, ত্রৈলোক্যনাথ বিশ্বাস (মথুুরবাবুর ছেলে) তাঁকে ‘পরোক্ষ ভাবে’ তাড়িয়ে দেন। এ নিয়ে অবশ্য বিতর্ক ছিল, শেষে ত্রৈলোক্যবাবু নিজেই চিঠি লেখেন ‘বঙ্গবাসী’তে, ‘...স্বামী বিবেকানন্দ ও তাঁহার সঙ্গিগণ পরোক্ষভাবে মন্দির হইতে বিতাড়িত হইয়াছিলেন,প্রত্যক্ষভাবে অবশ্য নয়...স্বামীজি ও রাজাকে অভ্যর্থনা করিবার জন্য আমি কাহাকেও বলি নাই, এবং আমিও তাঁহাদের অভ্যর্থনা জানাই নাই। যে-ব্যক্তি বিদেশে যাওয়া সত্ত্বেও নিজেকে হিন্দু বলিতে পারেএমন কাহারও সহিত আমার বিন্দুমাত্র সম্পর্ক থাকা উচিত বলিয়া আমি বিবেচনা করি নাই।...প্রতিমার পুনরভিষেকের যে-সংবাদ আপনারা প্রকাশ করিয়াছেন, তাহা সম্পূর্ণ সত্য।’ (তার মানে দাঁড়ায়, স্বামীজি মন্দিরে ঢুকেছিলেন বলে কালীমূর্তির পুনরভিষেকের প্রয়োজন হয়েছিল!)
ছবি: সুমন চৌধুরী
শিকাগোয় প্রতাপ চন্দ্র মজুমদার নামে এক জন হিন্দু ধর্মের প্রতিনিধি হিসেবে গিয়েছিলেন, তিনি কলকাতায় রটিয়েছিলেন: বিবেকানন্দ ভণ্ড সন্ন্যাসী, আমেরিকায় নারীদের সঙ্গে পশুর মতো নোংরা জীবন কাটাচ্ছে। বিবেকানন্দ চিঠিতে লিখেছেন, ‘আমার বুড়ি মা এখনও বেঁচে আছেন, ...তিনি যদি শোনেন, তাঁর শ্রেষ্ঠ আশার, সবচেয়ে ভালবাসার সন্তানটি দূর দেশে গিয়ে পশুর মত জঘন্য নীতিহীন জীবন কাটাচ্ছে...তাহলে সে সংবাদ তাঁকে একেবারে মেরে ফেলবে।’ কলকাতার টাউন হল-এ বিবেকানন্দের ধন্যবাদ-সভা করা হয়, হাই কোর্টের বিচারপতি গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় সেই জনসভায় সভাপতিত্ব করেননি, কারণ: বিবেকানন্দ নাম গুরুদত্ত নয়, তা ছাড়া শাস্ত্রমতে ‘শূদ্রের’ সন্ন্যাসে অধিকার আছে কি না সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। শেষে উত্তরপাড়ার রাজা প্যারীমোহন মুখোপাধ্যায় বক্তৃতা দেন, তবে ‘স্বামী বিবেকানন্দ’ না বলে, ‘ব্রাদার বিবেকানন্দ’ বলেন। বিবেকানন্দের মৃত্যুর পর শোকসভায় সভাপতিত্ব করার প্রস্তাব ফিরিয়ে গুরুদাস বলেন, ‘হিন্দু রাজার আমল হলে তাঁকে ফাঁসিকাঠে ঝোলানো হত।’
কমিউনিস্টরা (যাঁদের একটা বড় অংশ ছিলেন বাঙালি) নেতাজিকে ‘তোজোর কুকুর’ বলেছিলেন সে তো সবারই জানা। কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র ‘পিপল’স ওয়র’-এ ছাপা হয় একের পর এক কার্টুন। কোথাও গাধারূপী সুভাষ বোসের পিঠে বসে সম্রাট তোজো। কোথাও ক্ষুদ্রকায় সুভাষচন্দ্রের হাত ধরে এগিয়ে আসছেন জাপানের বাহিনী। কোথাও কুকুররূপী সুভাষকে মাইক্রোফোনের সমানে তুলে ধরেছেন গোয়েব্ল্স।
বিদ্যাসাগর-বিরোধী কু-গাওয়ার কোরাসেও প্রবল শামিল বাঙালি। বিধবা বিবাহ আন্দোলনের সমর্থকরা যখন গান বেঁধেছেন, ‘বেঁচে থাকুন বিদ্যাসাগর চিরজীবী হয়ে’, বিরোধীরা স্লোগান ছুড়েছেন, ‘শুয়ে থাক বিদ্যাসাগর চিররোগী হয়ে’। উত্তরপাড়া বালিকা বিদ্যালয় পরিদর্শন করে ফেরার পথে গাড়ি উল্টে পড়ে মারাত্মক জখম হন বিদ্যাসাগর, পথে এক জনও এগিয়ে আসেনি তাঁকে তুলতে; বরং পরে-পরেই বাঙালির ‘রগুড়ে’ কলম ধরে ফেলে সেই দুর্ঘটনাকে:
‘উত্তরপাড়া স্কুল যেতে, বড়ই রগড় হল পথে,
এট্কিনসন উড্রো আর সাগর সঙ্গেতে।
নাড়াচাড়া দিলে ঘোড়া মোড়ের মাথাতে,
গাড়ী উল্টে পল্লেন সাগর, অনেক পুণ্যে গেছেন বেঁচে।’

বিদ্যাসাগর রাস্তায় বেরোলে লোকজন তাঁকে ঘিরে ফেলে ঠাট্টা-মশকরা করেছে, গালাগাল করেছে। এমনকী ‘সুপারি কিলার’ লাগিয়ে তাঁকে খতম করার চেষ্টাও চলেছে। শেষমেশ বীরসিংহের সিংহশিশুকে এক জেলে-সর্দার বডিগার্ড পর্যন্ত নিয়োগ করতে হয়েছিল।
নাইট ক্লাব ফেরত ভদ্রমহিলার দিকে আজও যে ভাবে কটাক্ষ হানে গোঁড়া কলকাতা, সে দিন স্ত্রীশিক্ষা নিয়েও ছবিটা তেমন ছিল। বোঝা যায়, ‘প্রেক্ষিত’ বদলেছে, এ শহর বদলায়নি। মেয়েদের স্কুলগাড়ি রাস্তায় বেরোলেই লোকে হাঁ করে তাকাত, শিশু-বালিকাদের উদ্দেশে ছুড়ে দিত কান-গরম-করা শব্দবাণ। ‘যত ছুঁড়ীগুলো তুড়ী মেরে কেতাব হাতে নিচ্চে’, দেখে শিউরে উঠত বাঙালি পুরুষতন্ত্র। প্রথম বাঙালি মহিলা ডাক্তার কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়কেও বহু কাঠখড় পুড়িয়ে স্বীকৃতি আদায় করতে হয়েছিল। তাঁর স্বামী দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় ‘অবলাবান্ধব’ পত্রিকায় লিখছেন, ‘কুলকামিনীদিগকে অবজ্ঞা করা অধিকাংশ লোকেরই প্রকৃতি, কতকগুলা লোকের প্রকৃতি এত তীব্র যে, নারীদিগের মঙ্গলার্থক একটি বাক্য শুনিলেও নিতান্ত বিরক্ত হন।’ স্বভাবতই দ্বারকানাথের গায়েও তকমা লাগাল বাঙালি... ‘মেগে’!
বাঙালি এই উপহাস-প্রবণতার লেগাসি সগৌরবে বয়ে নিয়ে চলেছে। মিমিক্রি নিশ্চিত ভাবেই শিল্প, কিন্তু বাঙালি যে-ভাবে চপল ভাদুড়ি বা ঋতুপর্ণ ঘোষ সাজতে গিয়ে লাফটার শো থেকে লোকাল ট্রেন, মোড়ের আড্ডা থেকে ইউটিউব অবধি আবাদ করেছে ভাঁড়ামি, তাতে সে-জাতির স্থূল ক্যাওড়ামির চারিত্র্যই ফুটে ওঠে। কিছু মানুষের বডি, ল্যাঙ্গুয়েজ, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ হয়তো কোনও বিশেষ মানসিক শারীরিক সামাজিক অবস্থানই রয়েছে সেখানে, যা গতবাঁধা ধারণার বাইরে তাকে ব্যঙ্গ করা মানে শুধু নির্দিষ্ট সেই মানুষটিকে নয়, একই সঙ্গে আরও বহু সহনাগরিককে অপমান করা। তাঁদের ব্যক্তি-স্বাধীনতায় হাত দেওয়া।
স্বাধীন জীবন যাপন করতে গিয়ে বাঙালির হাতে ‘জিনা-হারাম’ হওয়ার আর এক উদাহরণ সৈয়দ মুজতবা আলী। ষাটের দশকের শুরুর দিকে মুজতবা আলী ফের শান্তিনিকেতনে, খ্যাতির শীর্ষে। স্বভাবতই বেরিয়ে পড়ল ঈর্ষার ঝুলি। ঠিকমত ক্লাসে না যাওয়া, গবেষণার কাজ না করা, অনিয়মিত জীবনযাপন, মদ্যপান এ সবের অভিযোগ উঠতে লাগল। একেবারে কোণঠাসা করে দেওয়া হল তাঁকে। মুজতবা আলী এ সময় কাউকে চিঠি লিখলে, চিঠির মাথায় লিখছেন: ‘শ্মশান, শান্তিনিকেতন’! অন্নদাশঙ্কর রায় মুজতবা আলীকে উদ্ধৃত করেছেন: ‘যত দিন আমার চাকরি ছিল না সকলে আমার বন্ধু ছিল, এখন আমি সকলের ঈর্ষার পাত্র।’ তিনি পাকিস্তানের গুপ্তচর এমন কথাও রটে। শেষে গোয়েন্দা পুলিশের জেরার মুখোমুখিও হতে হয় তাঁকে।
আবার, গায়ক সুমন কেন জিন্স পরেন এ নিয়েও এক সময় বাঙালি ভাবুকদের ভাবনার শেষ ছিল না। বছর কয়েক পর সুরসিক বাঙালি কতকটা এই রকমই নিদান দিল সুমন ধর্ম বদলেছেন, নাম পাল্টেছেন, একাধিক বিয়ে করেছেন, অতএব তিনি ফালতু গায়ক! সুমনও চেষ্টা করেছিলেন বাঙালিকে চিনতে ‘কারা এত রেগে যাচ্ছিলেন? এত মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন আমাকে অপদস্থ করার জন্য? টিকিট ব্ল্যাকার, গুন্ডা, দাগি আসামি, ছাতুঅলারা, ‘ছাতা-সারাবে’ বলে যাঁরা ঠা ঠা রোদ্দুরে হেঁটে যান কলকাতার পথ ধরে, ফেরিঅলারা, বস্তিবাসীরা, লটারির টিকিট-বিক্রেতারা? কারা?’
আমরা। আমরাই সেই বাঙালি, যারা সামনে আসার মুরোদ নেই বলে ‘পিছনে’ লাগি। ‘বক দেখানো’ থেকে ‘বাঁশ দেওয়া’ যাদের ফেভারিট হবি। দেব-সেনাপতিকে যারা অবহেলায় বানায় ‘ক্যালানে কাত্তিক’!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.