নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না দুলাল মণ্ডল। এক সপ্তাহ জলে ডুবে থাকা সত্ত্বেও পচে যায়নি ধানগাছ। গদখালি গ্রামের প্রবীণ কৃষক দুলালবাবু এ বার খরিফ মরসুমে ন’বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছিলেন। অগস্টে দু’-তিন দিনের টানা বৃষ্টিতে মাঠে জল দাঁড়িয়েছিল প্রায় ২০ ইঞ্চি। এক সপ্তাহের আগে জল সরেনি। দুলাল মণ্ডলের কথায়, “অদ্ভুত কাণ্ড! অন্য বার পাঁচ দিন এ রকম অবস্থা থাকলেই ধান গাছ পচে যায়। এ বার তা হয়নি!”
একই অভিজ্ঞতা বিদ্যুৎ মাইতির, যিনি চাষ করেছিলেন ১৫ বিঘায়। বিদ্যুৎবাবুর বক্তব্য, “জল সরতে এক সপ্তাহ লাগল দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কারণ, ২০০৯-এ অতিবৃষ্টিতে আমার প্রায় ৩২ বিঘা জমির ধান পচে গিয়েছিল। সে বার পাঁচ-ছ’দিন জল ছিল জমিতে। কিন্তু এ বার দিব্যি টিঁকে গেল সব গাছ।”
এ বার তাঁরা ফলনও পেয়েছেন বেশি। অন্য বার যেখানে বিঘা প্রতি বড় জোর পাঁচ-সওয়া পাঁচ কুইন্টাল ধান পাওয়া যায়, এ বার সেখানে প্রতি বিঘায় ফলন সাড়ে ছয়-পৌনে সাত কুইন্টাল। গদখালির আরও ২৬২ জন কৃষকের একই অভিজ্ঞতা। নভেম্বর মাসের মধ্যে তাঁদের অধিকাংশই ফসল ঘরে তুলেছেন। |
ওই কৃষকেরা এ বার চাষ করেছেন কেন্দ্রীয় সরকারের ‘জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা অভিযান কর্মসূচি’র আওতায়, যেখানে তাঁদের বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়েছিল বিশেষ ধরনের ধান বীজ। যে বীজ থেকে জন্মানো চারা জলে ডোবা অবস্থায় ১৫ দিন পর্যন্ত ঠিক থাকে। সুন্দরবনের কাছে, বিদ্যাধরী নদীর পাড়ে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার বাসন্তী ব্লকের ওই এলাকার অধিকাংশ চাষের জমিই নিচু। উপরন্তু ওই এলাকায় বছরে সাধারণত ১,৮০০ থেকে ২,০০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়, যেখানে খরিফে ১,২৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিই ধান চাষের জন্য যথেষ্ট বলে কৃষি বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন। এই অবস্থায় প্রায় প্রতি বছর ওই এলাকায় বহু জমিতেই খরিফে ধানের চারা জলে ডুবে যায় এবং ক্ষতির মুখে পড়েন কৃষকেরা।
এ সব বিবেচনা করেই কেন্দ্রীয় সরকারের ওই কর্মসূচি কার্যকর করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল যে সংস্থাটির উপরে, সেই ‘ইন্টারন্যাশনাল রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ (ইরি) মসজিদবাটি গ্রাম পঞ্চায়েতের ১০০ হেক্টর এলাকাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বেছে নেয়। সেখানকার ২৬৪ জন চাষিকে ওই বীজ দেওয়া হয়।
কর্মসূচির স্থানীয় পরামর্শদাতা ও কৃষি বিশেষজ্ঞ সুবীর চৌধুরী বলেন, “ধানের ওই বিশেষ বীজটি হল স্বর্ণ সাব-ওয়ান। আমাদের চাষিদের মধ্যে স্বর্ণ ধান উচ্চফলনশীল জাত হিসেবে বেশি পরিচিত। কিন্তু স্বর্ণ সাব-ওয়ান একই সঙ্গে টানা ১৫ দিন জলে ডুবে থেকেও নষ্ট হয় না। গত বছর ওড়িশায় এই জাতের ধান চাষ করে ভাল ফল পাওয়া যায়।” ওই কৃষি বিশেষজ্ঞ জানান, বছর তিনেক আগে কটকের সেন্ট্রাল রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউট এবং ‘ইরি’-র গবেষণায় ধানের এই জাতটি তৈরি হয়। গদখালির ফলন দেখে বোঝা যাচ্ছে, এই রাজ্যেরও নিচু এলাকায় এই জাতের ধান চাষ করলে কৃষকেরা লাভবান হবেন। মুর্শিদাবাদের কান্দির মতো এলাকাতেও এই জাতের ধান চাষ করলে ফলন মার খাবে না বলে দাবি সুবীরবাবুর। ‘ইরি’ স্থানীয় ভাবে যে সংস্থাকে ওই কর্মসূচি রূপায়ণের দায়িত্ব দিয়েছিল, তাদের কৃষি তত্ত্বাবধায়ক পরিমল বসু বলেন, “বাসন্তীর এই এলাকায় ফি বছর ধানি- জমি জলে ডুবে ফসল নষ্ট হয়। সে জন্যই গদখালিকে আমরা বেছে নিই।”
গদখালির কৃষক ভাস্কর মণ্ডল ও দুখীরাম মণ্ডলের বক্তব্য, “আমরা সাধারণত যে সব ধান চাষ করি, তারা এত জলে বাঁচে না। এই বীজের জল সহ্য করার ক্ষমতা আছে।” রাজ্য কৃষি দফতরের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার সহ-অধিকর্তা আশিস লাহিড়ীর বক্তব্য, “দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাসন্তী, গোসাবা, কুলতলি, জয়নগরের মতো এলাকায় চাষিদের মধ্যে স্বর্ণ সাব-ওয়ানের ভাল চাহিদা হয়েছে। কিন্তু এখনও ততটা জোগান দেওয়া যাচ্ছে না। আসলে এটা নতুন ধরনের বীজ। আশা করি, ভবিষ্যতে এই সমস্যা থাকবে না।” |