মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমিনীতির জন্য অন্তত ৬০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হারাল রাজ্য সরকার!
বর্ধমান জেলার দামাগোড়িয়া-চাপতোড়িয়া (পূর্ব) খনি থেকে কয়লা তোলার সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছিল রাজ্য সরকারি সংস্থা পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগম (পিডিসিএল)। এ জন্য সেখানে পাঁচটি গ্রামের জমি অধিগ্রহণ করতে হত। কিন্তু বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রী জানতে পেরে নির্দেশ দেন, গ্রামবাসীদের উচ্ছেদ করে জমি অধিগ্রহণ করা হবে না। বাধ্য হয়ে, হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলার মতো কয়লা মন্ত্রকের হাতে খনিটি তুলে দিয়েছিল নিগম।
আর আজ সেখানেই খনি খোঁড়ার কাজ শুরু করে দিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ভারত কোকিং কোল লিমিটেড (বিসিসিএল)। দামাগোড়িয়ার মানুষ স্বেচ্ছায় জমি তুলে দিচ্ছেন বিসিসিএলের হাতে। বিনিময়ে জমির দাম ছাড়া পাচ্ছেন চাকরির প্রতিশ্রুতি।
নতুন সরকারের জমিনীতির কারণে কী হারাল রাজ্য?
কেন্দ্রীয় কয়লা মন্ত্রকের হিসেব, দামাগোড়িয়া সংলগ্ন ছয়টি মৌজায় ২২০ একর জমির নীচে ৩০ কোটি টনেরও বেশি কয়লা রয়েছে। এর বেশির ভাগটা কোকিং কয়লা (যা ইস্পাত শিল্পে চড়া দামে বিক্রি হয়)। পাওয়া যাবে নন-কোকিং কয়লাও। সব মিলিয়ে কয়লার দাম টন প্রতি গড়ে ২০০০ টাকা করে ধরলে সহজ অঙ্কেই ওই খনি থেকে অন্তত ৬০ হাজার কোটি টাকার কয়লা তোলা যাবে। |
খনি খোঁড়ার কাজ চলছে দামাগোড়িয়ায়। —নিজস্ব চিত্র |
শুধু তা-ই নয়। নিগমের কর্তাদের বক্তব্য, কয়লা ব্লক পাওয়া নিয়ে এখন রাজ্যগুলির মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলছে। এই অবস্থায় দামাগোড়িয়া খনি প্রকল্পের কাজ শুরু হলে রাজ্যের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলিও কয়লা পেত। পাশাপাশি কোকিং কয়লা বিক্রি করে রাজ্যের আর্থিক সঙ্কট মেটানোর ক্ষেত্রেও বড় ভূমিকা নিতে পারত এই প্রকল্প। রাজ্যের প্রাপ্তি বলতে এখন শুধু কয়লা থেকে পাওনা সেস। তার মূল্য, হারানো ব্যবসার তুলনায় অনেকটাই কম।
কয়লা মন্ত্রকের এক কর্তার মন্তব্য, “খনি পাওয়ার জন্য প্রতিটি রাজ্য যেখানে হত্যে দিয়ে দিল্লিতে পড়ে থাকে, সেখানে পশ্চিমবঙ্গ স্বেচ্ছায় দামাগোড়িয়া খনিটি ফিরিয়ে দিয়েছে!”
অথচ খনি প্রকল্পের জন্য ওই প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ স্বেচ্ছায় জমি দিচ্ছেন। ওই অঞ্চলে চাষ-আবাদ প্রায় কিছুই নেই। আশপাশে আরও কয়লা খনি থাকায় দূষণের কারণে ওই জমি আর কৃষিকাজের জন্য উপযুক্ত নয়। ফলে স্থানীয় গ্রামবাসীরা খনি প্রকল্পের জন্য সাগ্রহে জমি তুলে দিচ্ছেন বিসিসিএল-এর হাতে।
গ্রামবাসীদের মতে, প্রকল্পটি রাজ্য সরকার করতে চাইলেও সহজেই জমি পেয়ে যেত। তাঁরা এখন বলছেন, “প্রকল্পটি হলে আমাদের চাকরি হবে। জমির দামও মিলবে।” কাজ শুরু হলে এই খনি অঞ্চলটিকে ঘিরে যে ধরনের আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামো গড়ে উঠবে, তাতে গ্রামের জীবনযাত্রার মান বদলে যাবে বলেও তাঁদের বিশ্বাস।
বিসিসিএল সূত্রের খবর, দামাগোড়িয়া-লাগোয়া পড়িরা, লছমনপুর, চাপতোড়িয়া, দেবীপুর, লালবাজার, সবনপুর অঞ্চলে জমি অধিগ্রহণের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল। গত ৫ ডিসেম্বর নারকেল ফাটিয়ে প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। তবে ৭০ জনের মতো গ্রামবাসী জমি দিয়েও টাকা না পাওয়ায় চিন্তায় ছিলেন। এই পরিস্থিতিতে গত সোমবার বিসিসিএল প্রকল্পের কাজ শুরু করতে গেলে গ্রামবাসীরা বাধা দেন। তবে সেই সমস্যা এখন আর নেই বলেই বিসিসিএল কর্তারা দাবি করছেন। জমি রেজিস্ট্রি করে দাম দেওয়া এবং চাকরি দেওয়ার কাজ শেষ করতে কয়েক মাস লেগে যাবে। কিন্তু তত দিন অপেক্ষা করতে নারাজ বিসিসিএল কর্তারা চাকরি দেওয়ার নিশ্চিত প্রমাণ হিসেবে দশ দিনের মধ্যে চাকরিপ্রার্থীদের ডাক্তারি পরীক্ষা সেরে ফেলার আশ্বাস দিয়েছেন। আর তাতেই বরফ গলেছে। এমনকী প্রয়োজনীয় বাকি জমি মাসখানেকের মধ্যে বিসিসিএলের হাতে তুলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন গ্রামবাসীরা। “এই প্রকল্প নিয়ে আমরা যথেষ্ট আশাবাদী,” বলেছেন বিসিসিএল-এর চেয়ারম্যান তাপস লাহিড়ি।
অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে দামাগোড়িয়া খনিটি হাতে পেয়েছিল বাম সরকার। যা পরে দেওয়া হয় পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগমকে। কয়লা মন্ত্রকের সঙ্গে চুক্তিতে বলা হয়, দামাগোড়িয়া থেকে যা কোকিং কয়লা উঠবে, তার পুরোটাই বিক্রি করতে হবে কোল ইন্ডিয়ার সহযোগী সংস্থা বিসিসিএল-কে। তা বাজার দরের থেকে ৩০% কম দামে। যে নন কোকিং কয়লা মিলবে, তা নিগম নিজের তাপবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে কাজে লাগাতে পারবে। বিধানসভা নির্বাচনের আগে ওই প্রকল্পের কাজ শুরু করা হবে বলে টেন্ডারও ডাকা হয়েছিল। কিন্তু রাজ্যে পালাবদলের পর প্রকল্প নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত টেন্ডারও বাতিল করে দেওয়া হয়।
প্রশাসনিক সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রী পরিষ্কার জানিয়ে দেন, দামাগোড়িয়ায় জমি অধিগ্রহণ করা যাবে না। বরং কয়লা মন্ত্রককেই খনিটি ফেরত দেওয়া হোক। মহাকরণের খবর, মুখ্যমন্ত্রীর আপত্তি থাকায় তাঁর দফতর থেকে দামাগোড়িয়ার ফাইল পাঠিয়ে দেওয়া হয় বিদ্যুৎমন্ত্রী মণীশ গুপ্তের কাছে। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ মতো তিনি গত বছর অক্টোবরে খনিটি কয়লা মন্ত্রককে ফেরত দিয়ে দেন। চিঠিতে জানানো হয়, পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগম দামাগোড়িয়া খনি থেকে কয়লা তুলবে না। তাই ব্লকটি ফেরত দেওয়া হল। এ বিষয়ে বিদ্যুৎমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা হলেও প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি। কোল ইন্ডিয়ার এক কর্তা জানাচ্ছেন, জুলাই মাসে দামাগোড়িয়া খনিটি কোল ইন্ডিয়ার হাতে তুলে দেয় কয়লা মন্ত্রক। সেখানেই বৃহস্পতিবার থেকে কাজ শুরু করেছে বিসিসিএল। যা শুনে রাজ্যের এক বিদ্যুৎ কর্তার মন্তব্য, “ওটা একটা সোনার খনি। আমরা স্বেচ্ছায় হারালাম।” |