অভিযান চালালেই মেলে চোলাই ও তা তৈরির উপকরণ। কিন্তু কারবার বন্ধ হয় না। গত বছরখানেকে এমনই অভিজ্ঞতা খনি ও শিল্পাঞ্চলবাসীর। চিত্তরঞ্জন থেকে কাঁকসা, সর্বত্রই রমরমিয়ে চলছে চোলাই ও জাল মদের কারবার। কারবার বন্ধ না হওয়ার কারণ নিয়ে রয়েছে রাজনৈতিক চাপানউতোরও।
চোলাইয়ের রমরমার জন্য জামুড়িয়ার বাগধিয়া-সিদ্ধপুরকে আসানসোল-দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলের ‘মগরাহাট’ বলা যেতেই পারে। জ্যারিকেন বোঝাই চোলাই বীরভূম হয়ে নানা এলাকা, এমনকী ঝাড়খণ্ডেও পাচার হয়ে যাচ্ছে। জামুড়িয়ার চকতুলসি, দেশেরমহান, লোদা, গোবিন্দপুর, শেখপুর, ভাড্ডা, তালতোড়, সত্তর, ডোবরানা, চিঁচুড়িয়া চলছে এমন কারবার। পাণ্ডবেশ্বরের খোট্টাডিহি, কেন্দ্রা, ভুরি, ফরফরে, ছত্তিশগণ্ডা, কাঁকসার মলানদিঘি, দোমরা, তিলকচন্দ্রপুরেও তৈরি হচ্ছে চোলাই।
আবগারি দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, বুধবার রাতে তিন জায়গায় হানা দেয় তারা। দোমকা ও তিলকচন্দ্রপুরের দু’টি ঠেক থেকে ২০ লিটার চোলাই বাজেয়াপ্ত করা হয়। তবে পাচারকারীরা পালিয়ে গিয়েছে। কাঁকসার শিবপুরেও দেদার তৈরি ও বিক্রি চোলাইয়ের। ফরিদপুরের বালিজুড়ি, নবঘনপুর, মাদারবনি, লস্করবাঁধ, সরপির মাঝিপাড়া ও গৌরবাজারে প্রকাশ্যে চলছে কেনাবেচা। অন্ডলের উখড়ার মেথরপাড়া, বারাবনির ভানোড়া, মাঝিপাড়া, সাহেবপাড়া, বারাবনির রাঙাশালা, বরাকরের মোহনধাওড়া, মাঝিপাড়া, রানিগঞ্জের বাঁশতলা, নেপালিপাড়া, দুসাদপাড়া, বনমালীপুরে একই পরিস্থিতি।
আবগারি দফতর সূত্রে খবর, কুলটির সীতারামপুর, আসানসোল উত্তর থানা এলাকার রেলপাড় এলাকা এবং হিরাপুরের নরসিংহবাঁধে অবশ্য চোলাইয়ের বদলে নকল মদ তৈরি হয় বেশি। নরসিংহবাঁধ থেকে তিন বার উপকরণ-সহ নকল মদ তৈরির সামগ্রীও উদ্ধার করা হয়েছে। কিন্তু কারবার বন্ধ হয়নি। জামুড়িয়ার নিঘা বুদ্ধ কলোনিতেও জাল মদের কারবার চলছে।
আবগারি দফতরের বর্ধমান পশ্চিম বিভাগের যুগ্ম কমিশনার সুজিত দাস জানান, চলতি আর্থিক বছরে এপ্রিল থেকে নভেম্বর পর্যন্ত তারা ১৩০০টি মামলা দায়ের করেছেন। ৭৮৫০ লিটার চোলাই ও ৭২,১৯৫ লিটার অন্য সামগ্রী বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। গ্রেফতার হয়েছে ২১২ জন। এই আর্থিক বর্ষে ইতিমধ্যেই তাঁরা বৈধ ব্যবসা থেকে ৩২৭ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করেছেন, যা গত বর্ষের তুলনায় ৩১ শতাংশ বেশি। সেপ্টেম্বরে পানাগড়ে স্পিরিট ও চোলাইয়ের অন্য সামগ্রী সরবরাহে অভিযুক্ত চুনীলাল সাউকে গ্রেফতার করা হয়। ৪৩০ লিটার রেক্টিফায়েড স্পিরিটও বাজেয়াপ্ত হয়। সুজিতবাবুর দাবি, এ বার ওই এলাকায় চোলাই তৈরি অনেকটা কমবে।
আবগারি দফতর সূত্রে জানা যায়, চোলাই তৈরির জন্য গুড় সরবরাহ হয় বীরভূম ও ঝাড়খণ্ড থেকে। হুগলি ও বাঁকুড়া থেকে আসে স্পিরিট। স্পিরিটের সঙ্গে রং ও গন্ধ মিশিয়ে তৈরি হয় জাল বিদেশি মদ। পাশাপাশি, স্রেফ জল মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে নকল দেশি মদ। বোতলে বিভিন্ন দামি ব্র্যান্ডের লেবেল লাগিয়ে তা পাচার করা হয়। চোলাই তৈরির জন্য ৪০ কিলোগ্রাম গুড়ে ৫০ গ্রাম ইস্ট মিশিয়ে পচানো হয়। তাকে বলে পচাই। তা থেকে পাতন পদ্ধতিতে চোলাই তৈরি হয়। চোলাইয়ের রমরমা বন্ধ না হওয়ার জন্য পরস্পরকে দুষতে ব্যস্ত রাজনৈতিক দলগুলি। তৃণমূলের জেলা (শিল্পাঞ্চল) সাধারণ সম্পাদক ভি শিবদাসনের দাবি, “সিপিএমের আমলে চোলাই কারবার ফুলেফেঁপে উঠেছিল। বর্তমান রাজ্য সরকার আবগারি দফতরের পরিকাঠামো ঢেলে সাজাচ্ছে।” সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য তুফান মণ্ডলের পাল্টা দাবি, “তৃণমূল কর্মীরা চোলাইয়ের ঠেকে তোলাবাজি করে। তাদের মদতেই ঠেকগুলি চলছে।” বিজেপি-র আসানসোল জেলা কমিটির সম্পাদক পবন সিংহ ও কংগ্রেসের জেলা শিল্পাঞ্চল কমিটির সম্পাদক তরুণ গঙ্গোপাধ্যায়দের বক্তব্য, বাম আমলে চোলাইয়ের কারবার বেড়েছিল। এখনও তা চলছে রমরমিয়েই। |