ঈদের উপহার হিসেবে বাবার বাড়ি থেকে লাল টুকটুকে একটি শাড়ি পান লায়লা বিবি। কিন্তু মানানসই চুড়ি, টিপের পাতা, নখ-পালিশ নেই। তাই ওই শাড়ি পরলেই কেমন যেন সাদামাটা দেখায়! মহরমের আগে শাড়ির সঙ্গে পরার জন্য নখ পালিশ, চুড়ি ও টিপের পাতা কিনতে ননদ টুম্পা খাতুনকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির পাশেই গ্রামের হাটে যান লায়লা বিবি, যা বছর পাঁচেক আগেও ভাবা যেত না। সময়ের সঙ্গে বদলেছে গ্রামের চেহারা, বদল ঘটেছে মানুষের রুচিরও।
বছর পাঁচেক আগেও মাঝপাড়া এলাকার মানুষের কাছে হাট ছিল চাল-ডাল ও সব্জি কেনার জায়গা। সেই সঙ্গে জামাকাপড় থেকে জুতোসব কিছুই সাধারণের নাগালের মধ্যে মিলত। কিন্তু তার গুণগত ছিল অত্যন্ত নিম্নমানের। গ্রামের সাধারণ মানুষ একটু দামি কিছু কিনতে চাইলেই তাঁদের ছুটতে হত বাজারে। এখন গ্রামের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির সঙ্গে বদল ঘটেছে মানুষের রুচিরও। মোটা অঙ্কের দিনমজুরির টানে ভিন রাজ্যে পাড়ি দেওয়া গ্রামের মানুষগুলোর পাঠানো টাকা বদলে দিয়েছে এলাকার সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান। যেখানে এক সময়ে ঘর থেকে বারান্দায় বের হতে হলেও পরিবারের পুরুষ সদস্যদের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন হত। আজ সেখানেই গ্রামের মহিলারা স্বাধীন ভাবে হাটে গিয়ে নিজেদের পছন্দের জিনিস নিজেই খুঁজে নিচ্ছেন। গ্রামের মহিলাদের স্বাধীনতার দরজা যেন কোথাও হাট করে খুলে গিয়েছে! গ্রামজীবন বা গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রার পরিবর্তন শুধু নয়, পরিবর্তনের ছোঁয়া গ্রামের হাটগুলিতেও। গ্রামের শেষ প্রান্তে হাটের রুক্ষ মাটিতে এক টুকরো পলিথিন এবং মাথার উপরে পলিথিনের চাদর টাঙিয়ে বসলেও এখন সেখানেই গড়ে উঠেছে কংক্রিটের ইমারত। আসবাবপত্রেও এসেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। গ্রামের হাটে বিক্রি হচ্ছে নামী কোম্পানির পোশাক থেকে দামি জুতো। লায়লা বিবি বলেন, “বছর পাঁচেক আগেও আলতা, ফিতে, গন্ধ তেল চাইলে বাড়ির পুরুষদের দিকেই তাকিয়ে থাকতে হত। কখন তারা এনে দেবে। এর পরে তাঁরা যখন কিনে আনতেন, হয় পছন্দমত হত না নয়তো দাম বেশি নিত। আর এই নিয়ে পরিবারে নানা রকমের অশান্তিও হত।” |
ডোমকলের কুপিলা গ্রামের চাঁদমন বিবিও বলেন, “এক বার ঈদের আগে এক জোড়া চুড়ি আনতে বলেছিলাম স্বামীকে। পর পর তিন দিন তিনি ভুলে যান। শেষ পর্যন্ত তিনি যে চুড়ি নিয়ে এলেন, তা হাতে গলাতে পারিনি। তখন হাত খালি নিয়েই ঈদের দিন কাটালাম। এতে স্বামীরও খুব মন খারাপ হয়েছিল।” এখন চাঁদমন বিবিকে আর বায়না ধরতে হয় না স্বামীর কাছে। দুপুরের রান্না সেরে হাটের মোড়ে ঝকঝকে দোকানে পা রাখলেই মিলে যায় সব কিছু। হাট মালিক মহিদুল ইসলাম বলেন, “এখন গ্রামের হাটগুলো গ্রামের প্রাণকেন্দ্রে। হাটের চারপাশে ঘিরে গড়ে উঠেছে পাকা দোকান। সেখানে চাহিদা মত সব কিছুই পাওয়া যায়। ফলে বাড়ি থেকে হাঁটা পথে অনেক সময়ে গ্রামের মেয়ে-বৌয়েরা হাজির হন সেই সব দোকানে। তবে ভিন রাজ্য থেকে অর্থ জোগান না হলে গ্রামের বা হাটের ভোল বদল কিন্তু হত না।”
যেমন ডোমকলের মাঝপাড়ায় মানুষের চাহিদা মত গড়ে উঠেছে হাট। রীতিমত সাজানো পাকা দোকান, উঁচু তোরণদ্বার, বিদ্যুতের সংযোগ, পানীয় জলের ব্যবস্থা সবই আছে সেখানে। ওই এলাকার বাসিন্দা আসাদুল ইসলাম বলেন, “আগের দিনের গঞ্জগুলোর মতই এখন চেহারা হয়েছে হাটের। হাটকে কেন্দ্র করে দোকান নয়, যানবাহনের ব্যবস্থাও গড়ে উঠেছে। হাটের মোড় থেকেই ইঞ্জিন চালিত ভ্যান থেকে ম্যাজিক গাড়ি ছাড়ে। তাছাড়া গ্রামের মানুষ দিনের শেষে আড্ডা দেওয়ার জায়গাটাও বেছে নেন হাটের মধ্যে। চায়ের দোকানে খরিদ্দারদের মনোরঞ্জনের জন্য সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলে কেব্ল টিভি। কোনও দোকানে আবার ডিভিডি-র সাহায্যে হালফিলের সিনেমা দেখানো হয়।”
যদিও এক শ্রেণির হাট মালিকদের দাবি, বাজারের মত প্রশাসনের নজর থাকে না হাটের উপরে। অনেক হাটে শৌচাগার নেই। নেই বিদ্যুৎ সংযোগও। কিছু কিছু হাটে শেডের ব্যবস্থাও নেই। ফলে রোদ-বৃষ্টিতে বিপাকে পড়তে হয় ক্রেতাদের। যদিও ইসলামপুর হাটের অবস্থা নিয়ে সাফাই দিয়েছেন রানিনগর-১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি কংগ্রেসের বাবলু আলম। তাঁর কথায়, “বাজারের পরিসর বাড়লেও এখন অনেকেই হাটে যেতে পছন্দ করেন। আমাদের বাজারের হাটে শেড থেকে নিকাশি নালা সবই সংস্কার করা হয়েছে। প্রয়োজনে আরও আধুনিকীকরণ করা হবে।” |