মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিভিন্ন সময়ে দাবি করেছেন, সংখ্যালঘু উন্নয়নে তাঁর সরকারের দেওয়া প্রতিশ্রুতির প্রায় একশো শতাংশ ইতিমধ্যে পূরণ হয়ে গিয়েছে। অথচ গত দেড় বছরে রাজ্যে সরকারি চাকরিতে মুসলিমদের তেমন সুযোগ দেওয়া যায়নি বলে মুখ্যমন্ত্রীকে রিপোর্ট দিল তাঁরই হাতে থাকা সংখ্যালঘু উন্নয়ন দফতর।
এবং মহাকরণের খবর: পরিসংখ্যান দেখে মুখ্যমন্ত্রী যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। বিভিন্ন দফতরের চাকরিতে সংখ্যালঘু প্রার্থী নিয়োগ সংক্রান্ত তথ্য নিয়ে তিনি নিজেই এ বার সার্বিক ছবিটা বুঝে নিতে চাইছেন। পাশাপাশি সংখ্যালঘু নিয়োগের হার বাড়াতে সমস্ত দফতরকে সক্রিয় করার প্রক্রিয়াও শুরু হচ্ছে।
যোগ্য সংখ্যালঘু প্রার্থীরা যাতে সরকারি চাকরির সুযোগ থেকে কোনও ভাবে বঞ্চিত না-হন, মমতা গোড়া থেকে তার উপরে জোর দিয়েছেন। উপরন্তু শিয়রে পঞ্চায়েত নির্বাচন। সেখানে সংখ্যালঘু ভোট যে বড় নির্ণায়ক হয়ে উঠবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সে ক্ষেত্রে সরকারি চাকরিলাভের নিরিখে সংখ্যালঘুদের এতটা পিছিয়ে থাকা ভোটবাক্সে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে বলে সরকারের একটি মহলের আশঙ্কা। তাদের মতে, বিরোধীরাও বিষয়টি প্রচারে তুলে আনতে পারে।
তাই ‘খামতি’ মেটাতে সব দফতরকে কোমর বেঁধে নামার নির্দেশ। একই সঙ্গে বিগত পাঁচ বছরে রাজ্যের দফতরগুলোয় সংখ্যালঘু নিয়োগের হার খতিয়ে দেখা শুরু হয়েছে বলে মহাকরণের খবর। এক দফতরের কর্তা বলেন, মুসলিমদের চাকরিপ্রাপ্তির হার কত, সংখ্যালঘু উন্নয়ন দফতর থেকে তা ঘরোয়া ভাবে জানতে চাওয়া হয়েছে। সংখ্যালঘু দফতরের মন্ত্রী হিসেবে মুখ্যমন্ত্রী নিজে সেই সব হিসেব যাচাই করে দেখতে চান। বস্তুত প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবে বড়সড় ফারাক থেকে যাওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে যে সংখ্যালঘুদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে, সরকারও তার কিছুটা আঁচ পেয়েছে বলে নানা সূত্রের ইঙ্গিত। |
|
পুলিশে কত |
পদ |
২০১০ |
২০১১ |
সাব-ইনস্পেক্টর |
৫.৫৫ |
১.১৮ |
সার্জেন্ট |
১.৮৮ |
৫.১৭ |
কনস্টেবল |
১৩.৫২ |
নিয়োগই হয়নি |
মহিলা কনস্টেবল |
০ |
৩৩.৩৩ |
* কলকাতা পুলিশে সংখ্যালঘু নিয়োগের হার, শতাংশে |
২০১২ সালে নিযুক্ত ৮৭ জন সাব-ইনস্পেক্টর, সার্জেন্টের মধ্যে সংখ্যালঘু ১ জন |
* সূত্র: কলকাতা পুলিশ |
|
রাজ্যের ৩০ হাজার ইমামের জন্য মাসিক আড়াই হাজার টাকা ভাতা ঘোষণা করেছিলেন মমতা। রাজ্য ওয়াকফ্ বোর্ড-সূত্রের খবর: এ পর্যন্ত ২০ হাজার ৪৬৫ জন ইমাম ভাতা নিতে রাজি হয়েছেন। বাকিরা প্রত্যাখ্যান করেছেন। তৃণমূলের সংখ্যালঘু নেতাদের একাংশের দাবি: ইমাম-ভাতা মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রীর জনপ্রিয়তা তেমন বাড়াতে পারেননি।
শুধু তা-ই নয়, সংখ্যালঘু দফতরের নিজস্ব পর্যালোচনায় ধরা পড়েছে, গত আঠারো মাসে সরকারি চাকরিতেও মুসলিমদের জন্য তেমন সুযোগ সৃষ্টি করা যায়নি। প্রশাসনের এক সূত্রের মতে, এটা বোঝার জন্য শুধু কলকাতা পুলিশের বিভিন্ন পদে সাম্প্রতিক নিয়োগের তথ্যই যথেষ্ট। দেখা যাচ্ছে, কলকাতা পুলিশে এখন সব মিলিয়ে যে ২৫ হাজার ৮০২ জন কর্মী রয়েছেন, তার মধ্যে মুসলিম ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা সাকুল্যে ২ হাজার ২৮৩। শতাংশের বিচারে মাত্র ৮.৮!
এই তথ্য পেয়ে সংখ্যালঘু উন্নয়ন দফতর কলকাতা পুলিশকে পরবর্তী নিয়োগের সময়ে ‘সতর্ক’ হতে বলেছে। উল্লেখ্য, কলকাতা পুলিশ আরও চার হাজার কনস্টেবল নিতে চলেছে। ওই পদগুলোয় কত জন সংখ্যালঘু চাকরি পেলেন, নিয়োগপর্বের শেষে সেই হিসেব চায় দফতর। দফতরের এক কর্তার কথায়, “আমাদের আশা, এ বার কলকাতা পুলিশের নিয়োগ সংখ্যালঘুদের জন্য উৎসাহব্যঞ্জক হবে।” প্রসঙ্গত, নির্বিঘ্নে নিয়োগ প্রক্রিয়া সারতে ক’দিন আগে ডিএম-এসপি’দের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্স করেছেন স্বরাষ্ট্র-সচিব এবং রাজ্য পুলিশের ডিজি। তাতে নিয়োগে ‘স্বচ্ছতা’র উপরে সবচেয়ে জোর দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু পুলিশের মতো পরিষেবামূলক চাকরিতে এ হেন ‘ফরমান’-এর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন একাধিক পুলিশ-কর্তা। তাঁদের এক জনের প্রতিক্রিয়া, “এ ধরনের নির্দেশ অর্থহীন। কলকাতা পুলিশে অফিসার নেওয়া হয় লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে। সেখানে বাছাই হয় মেধার ভিত্তিতে, ধর্মের ভিত্তিতে নয়। কনস্টেবলের পদেও শারীরিক মাপজোক, সক্ষমতা ও লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হয়। সংখ্যালঘু যে সব প্রার্থী ওই মাপকাঠিতে উতরোতে পেরেছেন, তাঁরা তো চাকরি পেয়েছেন!” মহাকরণে একাধিক দফতরের সচিবদেরও বক্তব্য, “ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে ধর্মের বিচারে চাকরি তো সম্ভব নয়। তা ছাড়া গত দেড় বছরে সরকারি চাকরিতে বলার মতো নিয়োগই হয়নি।”
সংখ্যালঘু দফতরের তথ্য বলছে, সাচার-রিপোর্ট অনুযায়ী বাম জমানায় ২৭% মুসলিম বাসিন্দার রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে সরকারি চাকরিতে মুসলিম ছিলেন মাত্র ২.৭%। যেখানে ৯% মুসলিম জনসংখ্যার গুজরাতে প্রায় ৭% মুসলিম সরকারি চাকরি করেন। মমতা রাজ্যের এই অবস্থাটাই পাল্টাতে চাইছেন। প্রধানমন্ত্রীও তাঁর ১৫ দফা কর্মসূচিতে সংখ্যালঘুদের জন্য যত বেশি সম্ভব সরকারি চাকরির ব্যবস্থা করতে বলেছেন। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত অঞ্চলে থানা, হাসপাতাল বা স্কুল-কলেজে বেশি সংখ্যক সংখ্যালঘু কর্মী-অফিসার নিয়োগ করতে বলেছে কেন্দ্র।
কিন্তু এ রাজ্যে তো অত সংখ্যালঘু কর্মী-অফিসারই নেই!
অতএব কেন্দ্রের কথাও অনেক ক্ষেত্রে মানা যাচ্ছে না বলে প্রশাসনিক সূত্রের খবর। |