সারা বাংলাই যখন বৈষ্ণব রাসোৎসবের আয়োজন করে, বৈষ্ণবতীর্থ নবদ্বীপ কিন্তু সেই তিথিতেই প্রধানত শাক্ত রাস পালন করে। তবে সেখানে বৈষ্ণব রাসও উদ্যাপিত হয়। তৈরি হয় দুই ধারার মিলনোৎসব। সেই নবদ্বীপেই মহামহোপাধ্যায় শিতিকণ্ঠ বাচস্পতির প্রতিষ্ঠিত শবশিবা একই সঙ্গে ধারণ করেন বৌদ্ধ ভাবনাও। এই দেবীর পুজোয় শাক্ত, বৈষ্ণব, শৈব, বৌদ্ধ ভাবনায় তৈরি হয় প্রতিমা। বিভিন্ন ধারার মিলনকেন্দ্র হয়ে ওঠেন এই প্রতিমা।
আমপুলিয়া পাড়ার শিতিকণ্ঠের জন্ম ১৮৬৭ সালে। মৃত্যু ১৯৩৬ সালে। তিনিই প্রথম তাঁদের গৃহদেবী শবশিবা মাতার মৃন্ময়ী প্রতিমা গড়ে পুজো করতে শুরু করলেন। সেই সময়ে এই প্রতিমার উচ্চতা ছিল মানবীপ্রতিম বা তার থেকে সামান্য ছোট। পরে তা বেড়ে এখন ১৫ হাত বা ২২ ফুট করা হয়েছে। এই দেবীর দু’টি শিব। দেবীর গাত্রবর্ণ গাঢ় নীলবর্ণ। নীচের শবরূপী বিবর্ণ মহাদেব পীতবর্ণের। তিনি জড় জগতের প্রতীক। উপরের শিব নিত্য, শুদ্ধ, বুদ্ধ, ত্রি-গুণাতীতের প্রতীক। এই পুজোর উদ্যোক্তারা দাবি করেন, এই প্রতিমাটিই কালীর আদি রূপ। কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ এই রূপেরই পরিবর্তন করে দক্ষিণাকালীর মূর্তির প্রচলন করেছিলেন। কৃষ্ণনগরের রাজবাড়িতেও শবশিবার একটি মূর্তি রয়েছে।
এই পুজো এখন সর্বজনীন। নিজস্ব জমিতে ও নিজস্ব বেদীর উপরে পূজিত হন দেবী। নবদ্বীপে রাসোৎসবের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে। জগদ্ধাত্রী পুজো শেষ হওয়া অর্থই হল, নবদ্বীপে শুরু হয়ে যাবে রাসের প্রস্তুতি। কৃষ্ণনগর থেকে মানুষের নজর এ বার চলে যাবে নবদ্বীপের দিকে। কথিত রয়েছে, নবদ্বীপে শাক্ত রাস শুরু হওয়ার জন্য দায়ী এখানকার ব্রাহ্মণেরাই। তাঁরা সেই দুর্গাপুজোর মহালয়ার সময় থেকেই চলে যেতেন শিষ্যবাড়ি পুজো করতে। দূরদুরান্তের সেই শিষ্যবাড়িতে কালী পুজো পর্যন্ত থাকতেন তাঁরা। তারপরে যজমানের কাছ থেকে দক্ষিণা নিয়ে ফিরে আসতেন নবদ্বীপে। সেই দক্ষিণার অর্থেই তারপের বাড়িতে শুরু করতেন নিজের নিজের গৃহদেবতার পুজো। তাঁরা সকলেই শাক্ত উপাসক ছিলেন। তাই প্রধানত কালী পুজোই হত। বৈষ্ণবপীঠ নবদ্বীপে নিজের প্রভাব বজায় রাখতে নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রও সেই শাক্ত পুজোর জন্য সাহায্য করতেন। তিনি নিজেই অনেক পুজোকে সরাসরি অর্থ সাহায্য করতেন। যে কারণে, নবদ্বীপের বহু প্রাচীন পুজোয় এখনও কৃষ্ণনগরের রাজপরিবারের নামে সংকল্প হয়। এর মধ্যে শবশিবা বিশেষ ভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। রাজপরিবারেও যে কারণে তাঁর মূর্তি রয়েছে। |