|
|
|
|
পূর্বে নিষ্ক্রিয় প্রশাসন |
খাজনা দিতে নারাজ বাগদা চাষি |
সুব্রত গুহ • কাঁথি |
একই জমিতে তিন গুণ লাভের আশায় পূর্ব মেদিনীপুর জেলার উপকূলবর্তী ও পার্শ্বস্থ এলাকায় এখন বাগদা
চাষের রমরমা। সরকারি
বিধিনিষেধ না-মেনেই কৃষিজমিতে নোনাজল ঢুকিয়ে চলছে বাগদা চাষ। ফলে একদিকে
যেমন কৃষিজমি কমছে, তেমনই
পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। অনেক সময় লোকসানে পড়ে সর্বস্বান্ত
হচ্ছেন
বাগদা চাষি। এই দুই চিত্র নিয়েই
প্রতিবেদন আনন্দবাজারের। আজ দ্বিতীয় কিস্তি। |
সরকারি বিধিনিষেধ উপেক্ষা করেই পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় সমুদ্র ও নদী তীরবর্তী এলাকায় বিঘার পর বিঘা জমির চরিত্র পরিবর্তন করে বাগদা চাষ চলছে। এই ভাবেই নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য। বাগদা চাষের জন্য নির্ধারিত জমির পাশের কৃষিজমিতে লবণের ভাগ বাড়ছে। ফলে মার খাচ্ছে ধান চাষ। এই প্রবণতা রুখতে মুখে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেও বাস্তবে তা কার্যকর করতে পারছে না প্রশাসন।
প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০০৬ সালে নোনা জলে মৎস্যচাষকে ‘অ্যাকোয়া কালচার অ্যাক্টিভিটি’র আওতায় এনে একর প্রতি দু’টাকা খাজনা ধার্য করে বাম সরকার। ৩০০০ মৎস্যচাষিকে বাগদা চাষের লাইসেন্স দেওয়া হয় সে বার। কিন্তু ২০১০ সালে দেশপ্রাণ ব্লকের দরিয়াপুরের জনৈক কালীপদ জানা বাগদা চাষের জন্য তাঁর জমিতে চাষবাস নষ্ট হচ্ছে বলে অভিযোগ জানান হাইকোর্টে। তখন লাইসেন্স নবীকরণে নিষেধাজ্ঞা জারি করে হাইকোর্ট। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আবার হাইকোর্টে মামলা করে কলকাতার সুরেন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউট অফ অ্যাকোয়া কালচার ট্রেনিং অ্যান্ড রিসার্চ নামে একটি সংস্থা। এরপরেই ২০১১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ বাগদা চাষের আগে ভূমি দফতর থেকে জমির চরিত্র বদলের অনুমোদন করানো, মৎস্য দফতর থেকে লাইসেন্স ও লাগোয়া কৃষিজমির মালিকদের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক করার নির্দেশ দেন। সেই নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরই ২৬ সেপ্টেম্বর তমলুকে জেলাশাসকের দফতরে কোস্টাল অ্যাকোয়া-কালচার অথরিটির এক বৈঠক হয়। বৈঠকে ঠিক হয়, বাণিজ্যিক ভাবে বাগদা চাষ করার জন্য প্রতি ডেসিমেল জমির খাজনা বাবদ ৫০ টাকা করে দিতে হবে।
বাস্তবে অবশ্য এই সব নিয়মকানুনের ধার ধারে না কেউ। খাজনা এড়াতে সরকারি বিধিনিষেধ ও হাইকোর্টের নির্দেশ উপেক্ষা করেই যথেচ্ছ হারে বাগদা-চাষ চলছে। মৎস্য দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী চলতি বছরের অক্টোবর মাস পর্যন্ত মৎস্য দফতর থেকে মাত্র ১৯৯টি ভেড়ি বাগদা-চাষের লাইসেন্স সংগ্রহ করেছে। যার মধ্যে ৮০টি নতুন, বাকি ১১৯টি পুরনো। সব মিলিয়ে মাত্র ৮০ হেক্টর জমিতে বৈধ ভাবে বাগদা চাষ হচ্ছে।
বাগদা চাষের জন্য কৃষির ক্ষতি হচ্ছে বলে প্রচুর অভিযোগ সাম্প্রতিক কালে জমা পড়েছে কৃষি দফতরে। নন্দকুমার, হলদিয়া ও নন্দীগ্রাম ব্লকেই বাগদা-চাষি ও কৃষি জমির মালিকদের মধ্যে চার-পাঁচশোটি হাতাহাতির ঘটনা নিয়ে অভিযোগ দায়ের হয়েছে। ভগবানপুর ২ ব্লকের একতারপুর গ্রামে কৃষি দফতরের অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম অধিকর্তা অমলেশ জানা বলেন, “পাশের জমিতে বাগদা চাষের জেরে আমার কৃষিজমি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় অভিযোগ জানিয়েছি। কিন্তু মৎস্য দফতর একটি তদন্ত করে সেই রিপোর্ট জেলা প্রশাসনে পাঠিয়েই দায় সেরেছে।” অভিযোগ জানিয়েও সুরাহা পাননি কাঁথি দেশপ্রাণ ব্লকের আমতলিয়া মৌজার রতন দাস, চিত্ত হাজরা, শুভ্রাংশু মল্লিক, প্রসূন মণ্ডল, খেজুরি ১ ব্লকের অজয়ার অজিত বেরা, চিত্তরঞ্জন বেরা, দক্ষিণ ইড়িঞ্চির কালাচাঁদ কামিলা, বীরবন্দরের বীরেন ধামার, মৌহাটির অন্নপূর্ণা বেরারা। কাঁথি ৩ ব্লকের বিএলএলআরও শ্রীকান্ত সাহু বহিত্রকুন্ডা মৌজার উত্তর রামচন্দ্রপুরে বেআইনি বাগদা-চাষের জন্য নন্দলাল শাসমল-সহ চার জনের বিরুদ্ধে মাস পাঁচেক আগে মারিশদা থানায় এফআইআর করেছিলেন। ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি কিছু। এই নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন জেলা পরিষদের মৎস্য কর্মাধ্যক্ষ বুদ্ধদেব ভৌমিকও। কিন্তু তৃণমূলই যেখানে ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের দায়িত্বে, সেখানে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব তো বুদ্ধদেববাবুর উপরেও বর্তায়। বুদ্ধদেবববাবুর উত্তর, ‘‘আমরা জনপ্রতিনিধি। বিষয়টা প্রশাসনের। তাই বিষয়টি ওরাই ভাল বলতে পারবেন।”
জেলার অ্যাকোয়া-কালচার অথরিটির চেয়ারম্যান তথা পূর্ব মেদিনীপুরের জেলাশাসক পারভেজ আহমেদ সিদ্দিকি বলেন, “যে সব বাগদা ফার্ম ভূমি দফতর থেকে জমির চরিত্র বদল বা মৎস্য দফতর থেকে লাইসেন্স নেয়নি, তারা যাতে বাইরে রফতানি না করতে পারে বা ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ না পায়, তার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।” অবৈধ বাগদা চাষিদের বিরুদ্ধে এফআইআর করা সত্ত্বেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কেন জানতে চাইলে “বিষয়টি জেলা পুলিশের” বলে সযত্নে এড়িয়ে যান জেলাশাসক।
|
(শেষ) |
|
|
|
|
|