বিকেল চারটের ছবিটাকে অনায়াসে কাহিনির সারমর্ম হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
ব্যাট দর্শকদের দিকে মুখ করে। হেলমেট আলগোছে ধরে অন্য হাতে। বাইশ গজ দিয়ে ছুটছেন চেতেশ্বর পূজারা। ঠিক তখনই টিভি ক্যামেরা ধরল ওয়াংখেড়ের ড্রেসিংরুম।
পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সহবাগ-যুবরাজ-সচিনরা। ঠোঁটে চওড়া হাসি, অক্লান্ত হাততালি। বীরু আবার ‘লিটল মাস্টারে’র কানের কাছে মুখ নিয়ে কিছু একটা বললেনও।
কী বললেন, জানার উপায় নেই। কিন্তু একটা জিনিস শুক্রবার আপামর দেশবাসী জেনে গেল। চব্বিশ বছরের সৌরাষ্ট্র যুবকের চোখ আর আকাশে আটকে নেই। আকাশের সীমানা ছাড়িয়ে দৃষ্টি এখন অনন্তের চৌকাঠে। যে লক্ষ্য সামনে রাখলে সহবাগ-সচিনের ইতিহাসের মঞ্চও আস্তে আস্তে বদলে যায় পূজারার বেদিতে। |
প্রথমে আমদাবাদ। আমদাবাদ শেষে মুম্বই। দু’টো ইনিংসের সঙ্গে যোগ হয়েছে আরও একটা। কিন্তু এই তিনটে ইনিংসের একটাতেও এখনও পূজারা-বধ হয়নি। বোলারের নাম জিমি অ্যান্ডারসন হোক বা গ্রেম সোয়ান, কিংবা এ দিনের বিস্ময়-বলের মালিক মন্টি পানেসর, কে পেরেছেন পূজারাকে ড্রেসিংরুমের রাস্তার সন্ধান দিতে? আর স্কোরগুলো দেখলে খোদ ‘দ্য ওয়াল’-এরও বোধহয় ঈর্ষা হবে। ২০৬, ৪১ এবং আজকের ১১৪। সব ক’টাই অপরাজিত।
সবচেয়ে বড় কথা, পূজারার জন্যই মুম্বই টেস্টে ধোনির গাড়ি টাল খেয়েও আবার ছুটছে। উইকেটে টার্ন আছে, আছে বাউন্স এবং ধোনির হাতে আছে হরভজন-সহ তিন স্পিনার। মন্টি পানেসর যদি স্বপ্নের ডেলিভারিতে টেস্টের প্রথম ঘণ্টায় নড়িয়ে দিতে পারেন সচিনের স্টাম্প, তুলতে পারেন চার উইকেট, দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিনে ভাজ্জি-অশ্বিনরা পারবেন না, এমন কথা বুক ঠুকে বলার সাহস উগ্র ইংরেজ সমর্থকেরও নেই। বিশেষজ্ঞরা ইতিমধ্যেই হিসেব কষছেন ‘উইনিং’ স্কোরের। প্রথম ইনিংসে নাকি তিনশোই যথেষ্ট। ভারত সেখানে আপাতত ২৬৬-৬। বিশেষজ্ঞদের তিনশো আর দূরের নীহারিকা মনে হচ্ছে না।
অথচ মুম্বইয়ের মঞ্চে আজ পূজারার জায়গা পাওয়ার কথাই নয়। সকাল ন’টা থেকে ধোনির বিশ্বজয়ের স্টেডিয়ামের চোখ খুঁজেছে সহবাগকে। শততম টেস্ট খেলতে নামছেন বীরু, হঠাৎই এক মরাঠি সমর্থক এক ঝটকায় শার্ট খুলে খালি গায়ে। পিঠে বড় বড় করে লেখা: ‘সহবাগ: সেঞ্চুরি টেস্ট, ওয়ান মোর সেঞ্চুরি।’ সচিন-আবেগও কি কম ছিল? গতকাল তাঁকে নিয়ে ক্লেটন মুর্জেলো-র সম্পাদনায় খালিদ আনসারির বই ‘সচিন: বর্ন টু ব্যাট’-এর উদ্বোধন হয়েছে রাহুল দ্রাবিড়ের হাতে। আজও প্রেমিক-প্রেমিকাদের ভিড়ের ঠিকানা মেরিন ড্রাইভ নয়, ছিল ওয়াংখেড়ে। ঘরের মাঠে যে জীবনের শেষ টেস্ট খেলতে নামছেন ভারতীয় ক্রিকেটের কিংবদন্তি। সচিনের একটা স্ট্রেট ড্রাইভ বাউন্ডারির দিকে ছুটল, ওয়াংখেড়ের গ্যালারিতে ড্রামের দুন্দুভি। কে জানত, মন্টি পানেসর নামের এক বাঁ-হাতি একাই এ ভাবে উৎসবের সাড়ে বারোটা বাজাবেন! |
অন-এ বিশাল ফাঁক দেখে পানেসরকে ও দিকে পাঠাতে চেয়েছিলেন সহবাগ। কিন্তু ইংরেজ স্পিনারের বল প্রথমে আছড়ে পড়ল তাঁর প্যাডে, শেষে অফস্টাম্পে। তবু সহবাগেরটা হজম হচ্ছে। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় তো বললেনও, “শততম টেস্টে ক’জন ভারতীয় আর সেঞ্চুরি করেছে?” কিন্তু সচিনেরটা কারওই হচ্ছে না। এ ভাবে পানেসরের টার্ন ফসকাবেন সচিন? ‘অ্যাক্রস দ্য লাইন’ খেলতে গিয়ে বোল্ড হবেন? পানেসরের সঙ্গে সচিনের সম্পর্কটা অদ্ভুত। রেষারেষি কম, তিনি সচিনের ভক্ত বেশি। স্মরণীয় গোটা কয়েক ঘটনাও আছে। গত বছর ইংল্যান্ড সফরে সচিনকে প্র্যাক্টিস দিয়ে ইসিবি-র কোপে পড়েছিলেন পানেসর। ২০০৮-এর নাগপুরে ইংরেজ স্পিনার যে বলে সচিনকে প্রথম আউট করেছিলেন, সেই বলে আবার সচিন লিখেছিলেন: ‘এ জিনিস আর হবে না।’ কিন্তু হয়েছে। পরে লর্ডসে হয়েছে। এ দিন ওয়াংখেড়েতেও হল। লাঞ্চের আগে মন্টি-সম্মোহনে প্রথমে ঠকঠকানি, তার পরমুহূর্তে ভারত ১১৮-৫!
ওই অবস্থায় দরকার ছিল জীবনদায়ী ওষুধের। যিনি পারবেন ব্যর্থতার গন্ধমাদন সরিয়ে টিমকে জীবনের বিশল্যকরণী খুঁজে দিতে। সেটা পূজারা ছাড়া আর কে দেবেন? দিনের দ্বিতীয় বল থেকে নেমে নব্বই ওভার পড়ে থাকা। ২৭৯ বলের ইনিংসে মাত্র এক বার ধৈর্যচ্যুতি। তাঁর ধৈর্য দেখে ক্রিকেটদুনিয়ার বিস্ময় লাগে, পূজারার নয়। কারণ, তা রাতারাতি আসেনি। ছোটবেলা থেকে ধর্মের প্রতি অন্ধ ভক্তি তাঁকে এই স্থৈর্য উপহার দিয়েছে। টিমের সঙ্গে সফর করার সময়ও দৈনন্দিন পুজো-আর্চা তাঁর বাদ পড়ে না। ব্যাগে থাকে ধীরুভাই অম্বানি, বারাক ওবামার জীবনী। যেখান থেকে নিজের মতো করে খুঁজে নেন জীবনে হারতে না শেখার রসদ। অক্লেশে বলে দিতে পারেন, “আপনারা আমার ধৈর্য, শৃঙ্খলা, দায়বদ্ধতা নিয়ে কথা বলেন। এগুলো ছোট থেকে মজ্জায় ঢুকিয়েছেন আমার মা।” তাঁর ইনিংস দেখে আপ্লুত সঞ্জয় মঞ্জরেকর টুইট করতে পারেন, ‘পূজারার আরও একটা অসাধারণ ইনিংস দেখলাম। এ বার স্পিনের সঙ্গে বাউন্স আর পেসটাও দুর্দান্ত ম্যানেজ করল।”
এর পরেও ‘দ্য ওয়াল’-এর উত্তরাধিকার নিয়ে সন্দেহ থাকবে?
|
ওয়াংখেড়ের স্কোর
ভারত প্রথম ইনিংস |
গম্ভীর এলবিডব্লিউ অ্যান্ডারসন ৪
সহবাগ বো পানেসর ৩০
পূজারা ব্যাটিং ১১৪
তেন্ডুলকর বো পানেসর ৮
কোহলি ক কম্পটন বো পানেসর ১৯
যুবরাজ বো সোয়ান ০
ধোনি ক সোয়ান বো পানেসর ২৯
অশ্বিন ব্যাটিং ৬০
অতিরিক্ত ২
মোট ২৬৬-৬
পতন: ৪, ৫২, ৬০, ১১৮, ১১৯, ১৬৯
বোলিং: অ্যান্ডারসন ১৪-৩-৪৯-১, ব্রড ১২-১-৬০-০,
পানেসর ৩৪-৭-৯১-৪, সোয়ান ২৬-৫-৫৯-১, সমিত ৪-১-৬-০। |
|
|