মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বিরুদ্ধে তাঁরই অস্ত্র ব্যবহার করলেন সূর্যকান্ত মিশ্র।
বিরোধী নেত্রী থাকাকালীন সিপিএমের অত্যাচারের অভিযোগ উঠলেই অত্যাচারিতের বাড়ি চলে যেতেন মমতা। সে ক্ষেত্রে সিপিএম-তৃণমূল বাছবিচার করতেন না। একই ভাবে এ দিন সূর্যবাবু গেলেন বালিতে নিহত তৃণমূল নেতা ও পরিবেশ-কর্মী তপন দত্তের বাড়ি। এর আগে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চেয়ে তিন বার চিঠি পাঠিয়েছিলেন তপনবাবুর স্ত্রী প্রতিমাদেবী। তাঁদের পরিবারকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে, এই অভিযোগ তুলে ঘুরেছেন প্রশাসনের দরজায় দরজায়। কিন্তু উত্তর মেলেনি। তখন তিনি গিয়েছিলেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের কাছে। সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে সূর্যবাবুর নেতৃত্বে বাম বিধায়কদের প্রতিনিধিদল শুক্রবার যখন তপনবাবুর বাড়িতে গেল, বাইরে তাঁদের গাড়ি ঘিরে চলল তৃণমূলের বিক্ষোভ।
গোটা ঘটনায় ফের স্পষ্ট হয়ে গেল নিহত তৃণমূল নেতার পরিবারের নিরাপত্তাহীনতা এবং রাজ্য রাজনীতিতে অসহিষ্ণুতার ছবি। |
বিরোধী দলনেতা দাবি করেছেন, এর পরে তপনবাবুর পরিবারের উপরে কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে মুখ্যমন্ত্রী তার দায়িত্ব এড়াতে পারবেন না। তপনবাবুর খুনের ঘটনায় তাঁর পরিবারের আইনি লড়াইয়ে পাশে থাকার আশ্বাসও দিয়েছেন সূর্যবাবুরা। শিল্পমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রী সময় দিয়েও দেখা করেননি বলে অভিযোগ করে তপনবাবুর স্ত্রী প্রতিমাদেবী বলেছেন, “যে আমাকে এই লড়াইয়ে সাহায্য করবে, আমি তার কাছেই যাব।” প্রতিমাদেবী নিজেও তৃণমূলের হয়ে নির্বাচনে জিতে সাঁপুইপাড়া-বসুকাঠি পঞ্চায়েতের সদস্য। কিন্তু এ দিন তাঁর দাবি, “এখন আমি কোনও দল করি না। মানুষের ভোটে জিতে মানুষের হয়ে কাজ করি।”
পরে রাতে এবিপি আনন্দের স্টুডিও থেকে ফোনে তিনি কৃষি বিপণন মন্ত্রী তথা হাওড়া জেলায় তৃণমূলের সভাপতি অরূপ রায়ের সঙ্গে কথা বলেন। প্রতিমাদেবী যে সিবিআই তদন্তের দাবি তুলেছেন বা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে যেতে পারছেন না, সে বিষয়ে কিন্তু কোনও রকম সাহায্যের আশ্বাস দেননি অরূপবাবু। তপনবাবুর খুনের ঘটনায় সিবিআই তদন্তের দাবি প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, “উনি (প্রতিমাদেবী) তো হাইকোর্টে গিয়েছেন। দেখা যাক না।” মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করা নিয়ে তিনি বলেন, “আমি কাউকে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে নিয়ে যাই না। আর মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গেলে অ্যাপয়েন্টমেন্টের দরকার হয় না।”
অনেকেই বলছেন, প্রতিমাদেবীদের বাড়ির সামনে এ দিন যা হল এবং তার পরে রাতে অরূপবাবু যা বললেন, তার থেকে ভরসা তো দূর, আশঙ্কাটাই বেশি হয়। বিশেষ করে ওই পরিবার যেখানে এখনও আক্রমণের লক্ষ্য। সম্প্রতি তপনবাবুর ভাগ্নে পিন্টুর উপরেও দুষ্কৃতীরা হামলা চালায়। তাৎপর্যপূর্ণ হল, এই বিষয়ে বলতে গিয়ে এ দিনই হাওড়া সিটি পুলিশের কমিশনার অজেয় রাণাডে বলেন, “ওর ভাগ্নে পিন্টু মদ্যপ অবস্থায় ঝামেলা করেই মাথা ফাটিয়েছে। ওর বিরুদ্ধেও মামলা করা হয়েছে।” প্রতিমাদেবী এ দিন বাম নেতাদের কাছে অভিযোগ করেন, সিআইডি তদন্ত করে প্রাথমিক চার্জশিটে যে ১৩ জনের নাম দিয়েছিল, তার মধ্যে রাজ্যের এক মন্ত্রী-সহ বেশ কয়েক জন স্থানীয় তৃণমূল নেতা-কর্মীর নাম ছিল। সেই মন্ত্রী অরূপ রায়। পরে অতিরিক্ত চার্জশিটে অরূপবাবু, স্থানীয় তৃণমূল নেতা-কর্মী গোবিন্দ হাজরা, কল্যাণ ঘোষ-সহ ৮ জনের নাম বাদ দেওয়া হয়। সূর্যবাবু বলেন, “বালির ক্ষেত্রে এটা একটা নতুন রেকর্ড। যেখানে কোনও প্রমাণ নেই বলে মন্ত্রী-সহ ৮ জনের নাম বিযুক্ত করা হয়েছে। তদন্তকারীকে বদলি করা হয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে, কী ভাবে এটা সম্ভব!”
সূর্যবাবুরা যখন দুপুরে বালির পশ্চিম শান্তিনগরে তপনবাবুর বাড়িতে পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলছেন, তখনই বাড়ির সামনে মিছিল করে আসেন স্থানীয় তৃণমূল কর্মী-সমর্থকেরা। তপনবাবুর বাড়ির সামনে দাঁড় করানো বিরোধী দলনেতার গাড়ির উপরে চড়-থাপ্পড় এবং ধাক্কা
মারে তারা। যদিও এই অভিযোগ অস্বীকার করে রাজ্যের মন্ত্রী তথা ডোমজুড়ের (তপনবাবু এই বিধানসভা এলাকার বাসিন্দা) তৃণমূল বিধায়ক রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “সিপিএম-কংগ্রেসের আঁতাঁত নিয়ে এটা আমাদের ঘোষিত মিছিল। ওঁরা আসবেন শুনে আমি বলেছিলাম, মিছিল সুষ্ঠু ভাবে নিয়ে চলে যেতে। এটাকে বিক্ষোভ বলে চক্রান্ত করা হচ্ছে। তপন দত্তের বাড়ির সামনে সরু রাস্তায় অনেকগুলি গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকায় জটলা হয়েছিল।” |
পরে সূর্যবাবু বলেন, “রোজই এই পরিবারের উপরে হামলা হচ্ছে। যাঁরা অভিযোগ করেছেন এবং যাঁরা অভিযুক্ত, দু’পক্ষই একই দলের হয়ে রাজনীতি করেন। তাই এটা দলীয় রাজনীতির বিষয়। সবার কাছে অনুরোধ, তার ঊর্দ্ধে উঠে সবাইকে এগিয়ে আসুন।”
এ দিন সূর্যবাবুর নেতৃত্বে সিপিএমের আনিসুর রহমান, ফরওয়ার্ড ব্লকের বিশ্বনাথ কারক, আরএসপি-র ঈদ মহম্মদ, সিপিআইয়ের আনন্দময় মণ্ডল বালিতে যান। সঙ্গে ছিলেন ডোমজুড়ের প্রাক্তন বিধায়ক সিপিএমের মোহন্ত চট্টোপাধ্যায়, অরূপ রায়। তাঁদের প্রতিমাদেবী জানান, যে দিন হাইকোর্টে সিবিআই তদন্তের আর্জি জানানো হয়, সে দিন থেকেই তাঁর নিরাপত্তারক্ষী তুলে নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, “আগে গোয়েন্দা বিভাগের নিরাপত্তারক্ষী থাকতো। এখন তা তুলে নেওয়া হয়েছে।”
অজেয় রাণাডে অবশ্য বলেন, “গোয়েন্দা বিভাগের নিরাপত্তারক্ষী কখনওই দেওয়া হয়নি। তবে থানার নিরাপত্তারক্ষী এখনও মোতায়েন আছে। গোয়েন্দা বিভাগ তার নিজের কাজে যেত। ওঁদের বাড়ির উপরে সব সময়ই নজরদারি চালানো হয়।”
|