|
|
|
|
৯ মাস ভাতা বন্ধ বনগাঁ শিশুশ্রমিক কল্যাণ বিদ্যালয়ে |
ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাতে আগ্রহ কমছে অভিভাবকদের |
সীমান্ত মৈত্র • বনগাঁ |
শিশুশ্রম কমাতে এবং শিশুশ্রমিকদের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনতে তাদের শিক্ষার জন্য ১৯৯৬ সালে বনগাঁ মহকুমায় চালু হয়েছিল ‘বনগাঁ শিশুশ্রমিক কল্যাণ বিদ্যালয়’। ন্যাশনাল চাইন্ড লেবার প্রজেক্টের অধীন ওই স্কুলের পড়ুয়াদের জন্য মাসে মাথাপিছু ১৫০ টাকা করে ভাতাও বরাদ্দ রয়েছে। কিন্তু গত মার্চ মাস থেকে পড়ুয়ারা ওই টাকা পাচ্ছে না বলে অভিযোগ।
স্কুল সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রতি মাসে দেড়শো টাকা করে ভাতা অবশ্য পড়ুয়াদের হাতে দেওয়া হয় না। তাদের নামে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ওই টাকা জমা পড়ে। নিয়মানুযায়ী ওই টাকা পড়ুয়া বা তার অভিভাবকেরা তিন বছর পরে তুলতে পারবেন। আর এখানেই দেখা দিচ্ছে সমস্যা।
কী সেই সমস্যা?
সাধারণ ভাবে সংসারে আর্থিক অনটনের কারণেই বাবা-মায়েরা তাঁদের ছেলেমেয়েদের কাজ করতে পাঠান। সে ক্ষেত্রে কাজে না পাঠিয়ে ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠালে তারা পড়াশোনাও শিখবে আবার টাকাও পাবে, এই সুবিধা থেকেই দরিদ্র পরিবারগুলি ছেলেমেয়েদের পাঠিয়েছিল বলে স্কুলের বক্তব্য। কিন্তু পড়ুয়াদের বরাদ্দ টাকা গত ৯ মাস ব্যাঙ্কে জমা না পড়ায় বহু অভিভাবকই এখন স্কুলে ছেলেমেয়েদের পাঠাতে উৎসাহ দেখাচ্ছেন না বলে স্কুল সূত্রে জানা গিয়েছে। সমস্যাটি নিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ কিছুদিন আগে অভিভাবকদের সঙ্গে বৈঠকেও বসেন। সেখানে অভিভাবকদের পক্ষ থেকে মাসিক ভাতা বাড়ানোর দাবি করা হয়। সেখানে অনেকেরই বক্তব্য ছিল, ছেলেমেয়েদের অন্যত্র কাজে পাঠালে মাসে হাজার টাকা করে পাওয়া যায়। আরও জানা যায়, গরু পাচারের ‘লাইন ম্যান’ হিসাবে লাগালে কাজ করলে দিনে প্রায় দেড়শো থেকে দু’শো টাকা পাওয়া যায়। সেখানে স্কুলে পাঠিয়ে ঠিকমত টাকা না পাওয়ায় অনেক অভিভাবকই এ ব্যাপারে আগ্রহ হারাচ্ছেন। তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী পূর্ণিমা ঘোষের মা পরিচারিকার কাজ করেন। আগে পূর্ণিমা মাকে কাজে সাহায্য করত। কিন্তু এখন সে নিয়মিত স্কুলে আসে। পিউ শীলের মা বিড়ি বাঁধেন। মায়ের সঙ্গে বিড়ি বাঁধত পিউও। কিন্তু এখন সে এই স্কুলের ছাত্রী। কিন্তু যে ভাবে ভাতার টাকা বন্ধ রয়েছে, তাতে এই সব পড়ুয়াদের আর কতদিন অভিভাবকেরা স্কুলে পাঠাবেন তা নিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষেরই সন্দেহ রয়েছে।
স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা ৫০ হলেও বাস্তবে হাজিরার সংখ্যা কম। মিড-ডে মিলের কারণেও অনেকে স্কুলে আসেন বলে স্কুল সূত্রের খবর। বহু পড়ুয়া বেলা ১১টা নাগাদ স্কুলে এসেই তাড়াতাড়ি খাবার চায় বলেও অনেক শিক্ষক জানিয়েছেন। স্কুলে অস্থায়ী ভিত্তিতে শিক্ষক রয়েছেন তিনজন। রয়েছেন একজন হিসাবরক্ষক। শিক্ষকেরা মাসে ৪ হাজার ও হিসাবরক্ষক ৫ হাজার টাকা পান। কিন্তু গত মার্চ মাস থেকে অবশ্য তাঁরাও কোনও টাকা পাচ্ছেন না। প্রধান শিক্ষক বিমলকুমার ভট্টাচার্য বলেন, “স্থায়ীকরণের জন্য সংশ্লিষ্ট মহলে বহুবার আবেদন জানিয়েছি। তার উপর যা সাম্মানিক পেতাম তাও বন্ধ থাকায় খুবই কষ্টে আছি।”
স্কুল চালু হওয়ার পরে ১৫ বছর কেটে গেলেও এখনও নিজস্ব বাড়ি নেই। স্থানীয় পাবলিক লাইব্রেরির ঘরেই স্কুল চলে। কোনও শৌচাগার না থাকায় পড়ুয়াদের সমস্যা হয়। এ ছাড়াও কিছু সমস্যা রয়েছে যা এ ধরনের স্কুলের উপযোগিতা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে। যেমন চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার সুযোগ থাকলেও কোনও পড়ুয়ার তিন বছরের বেশি পড়ার সুযোগ নেই এখানে। ফলে কেউ প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হলে তৃতীয় শ্রেণির পরে তাকে অন্য স্কুলে যেতে হয়। এই অবস্থায় অনেকেই পড়াশোনা ছেড়ে দেয়। আবার ৯ বছর বয়স না হলে কেউ এই স্কুলে ভর্তি হতে পারে না। ফলে ৬ থেকে ৮ বছরের পড়ুয়ারা পড়ার সুযোগ পায় না এখানে। এই অবস্থায় স্কুল কর্তৃপক্ষ বেশিরভাগ সময়েই দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তির উপর জোর দেন যাতে ওই পড়ুয়া চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করতে পারে। তার উপর কেউ পড়াশোনা ছেড়ে দিলে সে বিষয়ে জেলাশাসকের কাছে জানাতে হয়। সে ক্ষেত্রে অভিভাবকদের বুঝিয়ে পড়ুয়াদের ফের স্কুলমুখী করার চেষ্টা হয়। বিমলবাবু জানান, এই ব্যবস্থায় আগের চেয়ে স্কুলছুটের সংখ্যা অনেক কমেছে। তিনি আরও বলেন, “সম্প্রতি শ্রম দফতর থেকে নির্দেশ এসেছে চতুর্থ শ্রেণিতে পাশ করার পরে পড়ুয়ারা পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হচ্ছে কি না তার উপর রিপোর্ট তৈরি করে জমা দিতে বলা হয়েছে।”
স্কুলের সমস্যা প্রসঙ্গে জেলাশাসক সঞ্জয় বনশল বলেন, “কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রক থেকে স্কুলের জন্য অর্থ বরাদ্দ করা হয়। স্কুলটির শিক্ষক ও পড়ুয়ারা কেন টাকা পাননি সে বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।” অন্যান্য সমস্যা নিয়ে তাঁর বক্তব্য, ওই সব বিষয়ে বিস্তারিত খোঁজ না নিয়ে কিছু বলা সম্ভব নয়। |
|
|
|
|
|