মোতেরার স্কোর খুব সহজ। প্রথম ইনিংস-দ্বিতীয় ইনিংস ভুলে যান। ইংল্যান্ড ৫ উইকেটে ১০ —এটাই স্কোর। শেষ দিনের পুরো খেলা বাকি। তাই এখনও এমন অনমনীয় ইংরেজ লড়াইয়ের পরেও মহেন্দ্র সিংহ ধোনিরাই সবরমতীর পারে ফেভারিট। একই সঙ্গে আলেস্টার কুক ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে। যদি পারেন —যদি!
আমদাবাদ প্রেসবক্সের সবচেয়ে পিছনের সারিতে বসে আকাশি নীল রঙের যে শার্ট রোববার অন্য দিনের মতোই ল্যাপটপে ম্যাচ লিখছিলেন। তাঁর গৌরবে যে অবশেষে যুগ্ম ভাগীদার বসার উপক্রম হয়েছে জেনে গিয়েছেন। তিনি মাইক আথারটন। আজ থেকে সতেরো বছর আগে জোহানেসবার্গে একটা ইনিংস খেলেছিলেন যা যুদ্ধোত্তর ইংল্যান্ডের কোনও অধিনায়কের সেরা ম্যাচ বাঁচানোর বীরত্ব হিসেবে খ্যাত। আথারটন সাড়ে দশ ঘণ্টা ব্যাট করে ৪৯২ বল খেলেছিলেন। করেছিলেন অপরাজিত ১৮৫। কুক ব্যাট করেছেন আট ঘণ্টা পঁচিশ মিনিট। খেলেছেন ৩৪১ বল। করেছেন অপরাজিত ১৬৮।
আথারটনের ইনিংস এতই বন্দিত যে, তাঁর আত্মজীবনীতে একটা অধ্যায়ই রয়েছে জোহানেসবার্গের সে দিনের ওপর। আথারটন লিখেছেন, ‘ব্যাটসম্যান যদি ভাগ্যবান হয়, জীবনে কখনও না কখনও এমন ইনিংসের সঙ্গে সে জড়িয়ে যায় যা দিয়ে তাকে ব্যাখ্যা করা হবে পরবর্তী কালে। সে নিজে চাক বা না চাক, এই ইনিংসটাই হয়ে যাবে তাকে মাপার সর্বজনগ্রাহ্য দর্শন।’ রোববার কুকের অসমাপ্ত মহাকাব্যিক ইনিংস দেখার পর তাঁর প্রতিক্রিয়া কী? ভারতীয় মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলেন না প্রাক্তন ইংরেজ অধিনায়ক। তাই তাঁর মন্তব্য সরাসরি জানা গেল না। কিন্তু বিলেতের স্কাই নিউজকে এ দিন সন্ধ্যায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে আথারটন উচ্ছ্বসিত। বলেছেন, “আমি চাইব কালকে কুক আমার স্থায়িত্বের রেকর্ড ভেঙে দিক এগারো ঘণ্টারও বেশি ব্যাট করে। আর ম্যাচটা বাঁচিয়ে দিক।”
কুক ইতিমধ্যেই এমন রেকর্ড করে বসে আছেন যা আথারটনের তো নেই। অন্য কারও নেই। তা হল, প্রথম ক্যাপ্টেন মনোনীত অবস্থায় পরপর তিন টেস্টে সেঞ্চুরি। যে কোনও অধিনায়কের ঈর্ষণীয়। |
ঈর্ষণীয় কুকের না ঘামার ক্ষমতাও! এ দিনই আমদাবাদে শ্যুটিং করতে আসা অর্জুন রামপল টুইট করেছেন, গরমে পাগল হয়ে যাওয়ার জোগাড়। শ্যুটিং করাই যাচ্ছে না। কাজ শেষ করে উঠেই কোল্ড বিয়ার চাই। সেখানে সারা দিন ব্যাট করেও কুকের ঘাম নেই। অসমাপ্ত ষষ্ঠ উইকেটে যাঁর সঙ্গে তিনি ১২১ রান জুড়ে ফুল ও কাঁটার মাঝামাঝি ব্যাপক সংশয়ের স্টেশনে ভারতীয় দলকে রেখে দিয়েছেন, তিনি ম্যাট প্রায়র। প্রায়র আবার ভয়ঙ্কর ঘামেন। তিন ঘণ্টারও বেশি রোদ্দুরে ব্যাট করার পরে এক বালতি ঘাম গেল তাঁর। কিন্তু কুক এত ফ্রেশ যেন এখনই ব্যাট করতে যাবেন। সবচেয়ে আশ্চর্যের, সাড়ে আট ঘণ্টার ইনিংসে পরাস্ত হয়েছেন মাত্র চার-পাঁচ বার। ছক্কা? একটাও নেই। এই জায়গাটা আশ্চর্য নয় কারণ তিনি ক্রিকেটজীবনে সবচেয়ে বেশি বল খেলে প্রথম ছক্কা মারার বিশ্বরেকর্ড অল্পের জন্য ফসকেছিলেন। এর অধিকারী আজও সঞ্জয় মঞ্জরেকরের বাবা। বিজয় মঞ্জরেকর তাঁর জীবনে প্রথম ছক্কা মারেন টেস্টে ২৩০৮ বল খেলার পর। সবাই ভেবেছিল বল শূন্যে তুলতে চরম অনাগ্রহী কুক এটা নিশ্চিত ভাঙবেন। কিন্তু ২০৪৭ বল পর্যন্ত কাটিয়ে দেওয়ার পর কুকের ক্রিকেটজীবনে ‘দুর্ঘটনা’ বয়ে আসে। একটা টপ-এজ লেগে হঠাৎ করে ছক্কা হয়ে যায়।
এ দিনও ভারতীয় স্পিনারদের এত শাসনের পরেও কুক মাটিতে বল রাখার পুরনো অভ্যেস থেকে সরেননি। তাঁর ইনিংসের ওয়াগন হুইলে কুড়িটা বাউন্ডারি এবং বাকি সব স্কোরিং শট উইকেটের দু’দিকেই। ক্যাপ্টেন কুক্স টেস্ট ম্যাচ জার্নাল বলবে, ভারত যতই খেলা শেষে অজুহাত দিক, হঠাৎ করে পিচ স্লো হয়ে গেছে। চাপ বলে একটা বস্তু তো ভয়ঙ্কর ভাবে ছিলই। ছিল স্পিনারদের জন্য সামান্য টার্ন। কেভিন পিটারসেনের সুইপের জন্য আবার মারাত্মক ভুল বল বাছা নিয়ে এত কথা হচ্ছে। ওই একটা উইকেট খেলা পুরো ভারতের দিকে এনে দিয়েছিল। মনে হচ্ছিল পাঁচ দিনে পড়বে না টেস্ট। কিন্তু পিটারসেন তো সুইপ টাইমিংয়ের জন্যই এত বিখ্যাত। সুইচ-হিট স্ট্রোকটার তো জন্মই দিয়েছেন তিনি। যা দুর্ধর্ষ টাইমিং ছাড়া খেলা সম্ভব নয়। আজকেরটা ভুল হল তার কারণ মারাত্মক চাপ ছিল।
ভারতের মাঠে বিদেশি টিমের অবশ্যম্ভাবী টেস্ট হার বাঁচানোর দুটো নমুনা আছে গত পনেরো বছরে। ইংল্যান্ড কোচ অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারই তো বারো ঘণ্টা ব্যাট করে নাগপুরে উদ্ধার করেছিলেন জিম্বাবোয়েকে। আর এক বার সৌরভের ভারতকে মোহালি টেস্টের শেষ দিন আটকে দিয়েছিল আব্দুর রজ্জাকদের ব্যাট। নিশ্চিত হার বাঁচিয়ে ফেলে ইনজামামের পাকিস্তান।
সোমবার কী হবে? অন্তত দেড়খানা ভাল ব্যাটিং সেশন কাটিয়ে দিলে ধোনির আপাত শান্ত বহির্জগৎও আক্রান্ত হতে বাধ্য। আর একটা জিজ্ঞাসা অসমাপ্ত আছে। দ্বিতীয় ইনিংসে জেতার জন্য দ্রুত রান তোলা প্রয়োজন, এমন যদি পরিস্থিতি হয়, ধোনির নিয়মিত ওপেনিং কম্বিনেশন নামার অনুমতি পাবে? অনুমতি এ জন্য প্রয়োজন যে, রোববার সারা দিন গৌতম গম্ভীর মাঠে ছিলেন না। নয়াদিল্লি উড়ে গিয়েছেন তিনি খুব প্রিয় ঠাকুমার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে। নিয়ম হল, বাহ্যিক আঘাত ছাড়া অন্য কারণে কোনও ফিল্ডার যদি মাঠের বাইরে থাকে, তা হলে যতক্ষণ বাইরে ছিল ইনিংসের ঠিক ততটা সময় কাটলে তবেই ব্যাট করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে পারিবারিক মৃত্যুর ব্যাপারটা বিবেচনা করা না-করা এখন একান্ত ভাবে আম্পায়ারদের ওপর!
অ্যালেস্টার কুকের ক্রিকেটের পর প্রিয় শখ হল সঙ্গীত। পিয়ানো বাজান ভাল। এমনকী স্যাক্সোফোনও। ভারতীয় স্পিনাররা যারা সারা দিনে ৮০ ওভারে মাত্র দুটো উইকেট নিতে পেরেছে, তাদের অবশ্য কুকের আর কোনও সঙ্গীত শোনার স্পৃহা নেই। এই একটা উইকেট পেয়ে গেলে তখন সব হিসেবই যে দ্রুত বদলে যাবে, তখন যে পিয়ানোতে নতুন গান বাজবে, ধোনির মতো পোড়খাওয়ার চেয়ে বেশি ভাল আর কে জানে!
|
ভারত ৫২১-৮ ডিঃ
ইংল্যান্ড ১৯১ ও ৩৪০-৫ |
ইংল্যান্ড দ্বিতীয় ইনিংস (আগের দিন ১১০-০) |
কুক ব্যাটিং ১৬৮
কম্পটন এলবিডব্লিউ জাহির ৩৭
ট্রট ক ধোনি বো প্রজ্ঞান ১৭
পিটারসেন বো প্রজ্ঞান ২
বেল এলবিডব্লিউ উমেশ ২২
সমিত এলবিডব্লিউ উমেশ ০
প্রায়র ব্যাটিং ৮৪
অতিরিক্ত: ১০
মোট: ৩৪০-৫।
পতন: ১২৩, ১৫৬, ১৬০, ১৯৯, ১৯৯।
বোলিং: উমেশ ১৯-১-৬০-২, প্রজ্ঞান ৪৪-১৩-১০২-২, অশ্বিন ৪১-৯-১০৪-০, সহবাগ ১-০-১-০, জাহির ১৮-৩-৩৮-১, সচিন ১-০-৮-০, যুবরাজ ৪-০-১৭-০। |
|