রাজ্য সরকার ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি সত্ত্বেও বাস-মিনি-ট্যাক্সির ভাড়া না-বাড়াইবার ধনুর্ভঙ্গ পণ করিয়া রাজ্যের গোটা পরিবহণ ব্যবস্থাটিই বিপর্যস্ত করিয়া দিয়াছিল। পরিশেষে দীর্ঘ টালবাহানার পর যদি বা ভাড়া বাড়াইতে সরকার নিমরাজি হয়, বৃদ্ধির হার এবং কোন দূরত্বে কতটা বৃদ্ধি অনুমোদনযোগ্য, সে সংক্রান্ত চাপান-উতোরে অরাজকতা চরমে ওঠে। যান-মালিকদের সহিত পরিবহণ কর্মীদের দ্বন্দ্ব, ভাড়া-আদায়কারী কন্ডাক্টরদের সহিত নিত্যযাত্রীদের বিরোধ, বচসা, ঝগড়াঝাটি, অবশেষে পরিবর্তিত ভাড়ার পুনঃপরিবর্তনের হুকুম মনে হয়, এ রাজ্যে বুঝি কোনও সরকারই নাই। আর এই ধারণাটিকে বিশ্বাসযোগ্যতা দেয় পরিবহণ মন্ত্রী, পরিবহণ সচিব, মুখ্যমন্ত্রী এবং ভাড়া-বৃদ্ধি বিষয়ক মন্ত্রিগোষ্ঠীর পরস্পরবিরোধী সব উক্তি-বিবৃতি-সিদ্ধান্ত।
জ্বালানি ও যন্ত্রাংশের মূল্যবৃদ্ধি হইলে পরিবহণের খরচ এবং সেই হেতু বাস-মিনি-ট্যাক্সির ভাড়াও যে বাড়িবে, ইহা শিশুতেও বোঝে। এ জন্য কেন যান-মালিকদের ধর্মঘটের হুমকি দিতে হইবে, পরিবহণ মন্ত্রীকে পাল্টা হুমকি, পরিবহণ সচিব-মুখ্যসচিব, মন্ত্রিগোষ্ঠী, শিল্পমন্ত্রী, এমনকী খোদ মুখ্যমন্ত্রীকেও দফায়-দফায় বৈঠক করিতে হইবে, নিত্যনূতন ফরমান জারি করিতে হইবে, তাহা বোঝা দুষ্কর। ইতিকর্তব্য বিষয়ে চরম অজ্ঞতা এবং ভাড়াবৃদ্ধির মতো মামুলি বিষয়ে সিদ্ধান্ত লইতে কালঘাম ছুটিয়া যাওয়ার ঘটনা রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের মন্ত্রী ও আধিকারিকদের যোগ্যতা লইয়াই গভীর সংশয় তুলিয়া দেয়। সর্বশেষ শিল্পমন্ত্রী যে ভাষায় ও ভঙ্গিতে এ বিষয়ে সরকারি সিদ্ধান্তের কথা জানাইয়াছেন, তাহাতেও সরকারের প্রশাসনিক সংহতি লইয়া গহন সন্দেহ জাগিতে বাধ্য। প্রতিটি স্তরে অর্থাৎ নির্দিষ্ট দূরত্বের প্রতিটি পর্যায়ে এক টাকা করিয়া ভাড়া বাড়িবে, এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে এত দিন ধরিয়া এতগুলি মন্ত্রী ও আমলাকে কেন যাত্রিসাধারণের সহিত, যান-মালিকদের সহিত এবং পরস্পরের সহিত কুস্তি করিতে হইল, কে জানে? একজন আস্ত পরিবহণ মন্ত্রী, সচিব এবং ‘আরটিও’ থাকা সত্ত্বেও কেন মুখ্যমন্ত্রীকে ভাড়াবৃদ্ধির স্তর লইয়া মাথা ঘামাইতে হয় এবং শিল্পমন্ত্রীকে কেন মহাকরণে তাহা সবিস্তার ব্যাখ্যা করিতে হয়, সে রহস্যও অজানাই থাকিয়া যাইবে। শিল্পমন্ত্রী বলিয়াছেন, সরকারের কাজ সরকার করিবে। সেটাই তো করার কথা। কিন্তু করিতেছে কোথায়? সরকার যে শিল্পমন্ত্রী ও তাঁহার মুখ্যমন্ত্রীই চালাইতেছেন, অস্বস্তিকর প্রশ্নকারী সাংবাদিকরা নন, ইহাও জানা কথাই। কিন্তু তাঁহাদের উপর ‘সব ছাড়িয়া দিলে’ কী হয়, সেটা তো রাজ্যবাসী গত মাসখানেক হাড়ে-হাড়ে টের পাইতেছেন! সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়া শিল্পমন্ত্রীর ‘স্টেজ-ফেজ গুলি মারো’ কিংবা ‘ওটা লিখলে যদি বিক্রি বাড়ে, ওটাই লিখুন’ জাতীয় সদুক্তিকর্ণামৃত ইদানীং আর কানে বিসদৃশ বাজে না। মমতা মন্ত্রিসভার অনেক সদস্যই আজকাল এ ধরনের ভাষা ও ভঙ্গি রপ্ত করিয়া ফেলিয়াছেন। ইহা ক্ষমতার ভাষা। বড় দ্রুত ইহা আয়ত্ত হইয়া গিয়াছে। |