সম্পাদক সমীপেষু...
রবীন্দ্রনাথও ব্যতিক্রম নন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটক নিয়ে গিরিশ কারনাডের সাম্প্রতিক মন্তব্য বিতর্কের ঝড় তুলেছে। পক্ষে-বিপক্ষে বিভিন্ন মতামত শোনা যাচ্ছে বিভিন্ন মাধ্যমে। কিন্তু বিষয়ের কেন্দ্রীয় চরিত্র যখন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং তখন বলাই বাহুল্য, মন্তব্যের বিরোধিতারই পাল্লা ভারী। ১১ নভেম্বর অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদকীয় প্রবন্ধ (তবুও দুঃখ জাগে)-র সূত্র ধরেই কিছু কথার সূচনা করছি।
আমাদের জীবনে রবীন্দ্রনাথ ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছেন। প্রত্যন্ত গ্রামের কোনও নিরক্ষর ব্যক্তির কাছেও রবীন্দ্রনাথ পরিচিত নাম। অনেক ক্ষেত্রে জীবনে চলার অবলম্বনও বটে। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির সার্থকতা তো সেখানেই। আর সেই কারণেই তো তাঁর সৃষ্টি নিয়ে সমালোচনার অবকাশ থাকে। যে সৃষ্টির কোনও মাহাত্ম্য নেই, তা নিয়ে কোনও সমালোচনার উদ্রেক হয় না। কিন্তু সমস্যাটা হয় যখন আমরা সমালোচনাকে নিন্দার সঙ্গে সমার্থক ভেবে বসি। গঠনমূলক যে কোনও সমালোচনা সব সময়ই শিল্প সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে। তার কণ্ঠরোধ করে দিলে পুনরায় বিকাশের ইতি তো সেখানেই। ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথকে আমরা এতটাই আপন করে নিয়েছি যে, তাঁর যে-কোনও সৃষ্টিই যেন সমালোচনার ঊর্ধ্বে বলে ধরে নিয়েছি। কিন্তু শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে সমালোচনা না-থাকলে তার পরিসর তো বদ্ধ জলার মধ্যেই চিরকাল আবদ্ধ থাকবে। রবীন্দ্রনাথের দার্শনিক মূল্যবোধ তাঁর সাহিত্যের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়েছে বারে বারে সে সাহিত্য চিরকালীন। আর সেই কারণেই রবীন্দ্রনাথের গান বা কবিতার ক্ষেত্রে ভাষা, সুর আর চিন্তনের যে মেলবন্ধন ঘটেছে, সেগুলো অমর হয়ে রয়েছে আজও। কিন্তু নাটক শিল্পের এমন এক মাধ্যম, যাকে শুধু সাহিত্যমূল্যের নিরিখে বিচার করা চলে না, যা সমসাময়িক সমাজের দর্পণও বটে।
রবীন্দ্রনাটক এক দিকে বাংলা মৌলিক নাটক রচনার ক্ষেত্রে এক বড় অবদান তো বটেই, তাঁর নাটকে ভাষার চমৎকার প্রয়োগ, সংক্ষিপ্ত সংলাপ, সূক্ষ্ম দ্বন্দ্ব এক অন্য ধারার প্রবর্তন করে। এর সঙ্গে তাঁর মঞ্চশিল্পচেতনা বাংলা নাটকে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। তা সত্ত্বেও তাঁর নাটক মঞ্চস্থ করার ক্ষেত্রে সে সময়ে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি বা শান্তিনিকেতনের গণ্ডি খুব একটা অতিক্রম করেনি। তারই ফল, সমাজের নির্দিষ্ট শ্রেণির কিছু দর্শকের কাছেই নাটকগুলো পৌঁছয়। বরং রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগে তাঁর নাটক মঞ্চস্থ করার প্রয়াস দেখা যায় বেশি। অবশ্যই কিছু পরিবর্তনের প্রয়োজন হয় যুগের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখার তাগিদে। রবীন্দ্রনাথ নিজের নাটক রূপায়ণের বিভিন্ন পর্যায়েও আগের চিন্তাধারা ভেঙে নতুন ভাবে গড়েছেন “রবীন্দ্রনাথের মঞ্চচেতনার দ্বিতীয় পর্বে আমরা দেখিয়াছি, তিনি তাঁহারই সৃষ্ট পূর্ববর্তী মঞ্চচেতনার প্রতিবাদ করিয়াছেন। তেমনি তাঁহার অভিনেতৃ-জীবনের দ্বিতীয় পর্বে প্রথম পর্বের অভিনয়-রীতিকে তিনি যেন সজোরে অস্বীকার করিতে চাহিয়াছেন।” (বাংলা নাটকের ইতিহাস, অজিতকুমার ঘোষ, পৃ ২৫১)। গিরিশ কারনাড রবীন্দ্রনাথের নাটকের সমালোচনা করেছেন, ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের তো নয়। নাট্যব্যক্তিত্ব হিসেবে তাঁর কোনও বিশেষ ধারার নাটক পছন্দ না-ই হতে পারে এবং সেই মতবাদ যদি তিনি পরিশীলিত গণ্ডির মধ্য থেকে প্রকাশ করেন, তাতে আপত্তি থাকার তো কথা নয়! আর এ কথাটাও খুবই সত্যি, একজন যত বড় স্রষ্টাই হোন না কেন, তাঁর সব সৃষ্টি সমান ভাবে উচ্চ তারে বাঁধা থাকবে তা কখনওই সম্ভব নয়, রবীন্দ্রনাথও ব্যতিক্রম নন। সামাজিক প্রেক্ষাপটে নাটক বা ছায়াছবি শিল্পপ্রকাশের এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম, সেখানে যে-কোনও গঠনমূলক সমালোচনা অবশ্যই গ্রহণযোগ্য হওয়া প্রয়োজন, শুধু মাত্র আবেগের বশবর্তী না-হয়ে তাকে খোলা মনে গ্রহণ করতে পারলে আখেরে দেশের শিল্প-সাহিত্যেরই লাভ।
অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় (১১-১১) রবীন্দ্রনাথের নাটকের মহত্ব সম্বন্ধে কিছু জানতে চেয়েছেন। নাট্য-পাঠক হিসাবে রবীন্দ্রনাট্যের কয়েকটি মহান দিক তুলে ধরছি। ভরতমুনি তাঁর ‘নাট্যশাস্ত্র’ গ্রন্থের চতুর্দশ অধ্যায়ে ‘কক্ষা’ বা জোনাল অ্যাক্টিংয়ের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন যে, ‘রঙ্গপীঠ-পরিক্রমাৎ’ অর্থাৎ কোনও চরিত্র রঙ্গমঞ্চের এক অংশ থেকে অন্য অংশে চলে গেলে সেই চরিত্রটি অন্য স্থানে গমন করল এই রকম ধরে নেওয়া যেতে পারে। একটি দৃশ্যই বহু দৃশ্যে দেখানো সম্ভব এই ভাবে। ঊনবিংশ শতকের নাট্যকারেরা বাংলা নাটকে এই রীতি প্রয়োগ করেননি। তাঁরা অন্য স্থান বোঝাতে দৃশ্যান্তর ব্যবহার করেছেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁর বহু নাটকেই এই ‘কক্ষা-বিভাগ’ বা জোনাল অ্যাক্টিং দেখিয়েছেন। এতে নাটকের গতি বাড়ে এবং প্রযোজনার খরচ কমে।
গ্রিক ট্র্যাজেডি, রোম্যান্টিক ট্র্যাজেডি বা ইবসেনের ট্র্যাজেডিতে দুঃখের মধ্যেই নাটকের সমাপ্তি ঘটে। ব্র্যাডলে, কিটো, লুকাস প্রমুখ পাশ্চাত্য নাট্যতাত্ত্বিকগণ এটিকেই ট্র্যাজেডির বৈশিষ্ট্য বলেছেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টি করলেন এক নতুন ধরনের ট্র্যাজেডি। তাঁর কয়েকটি ট্র্যাজেডিতে চরিত্ররা প্রচণ্ড দুঃখ পেয়েও পরম সত্যদর্শনের মাধ্যমে দুঃখকে অতিক্রম করে যায়। উদাহরণস্বরূপ ‘বিসর্জন’, ‘পরিত্রাণ’, ‘বাঁশরী’-র নাম করা যায়। এই সব ট্র্যাজেডি পাঠক-দর্শককে ভূমি থেকে ভূমায় নিয়ে যায়।
তৎকালের নাটকে নায়ক চরিত্রকে বহু আড়ম্বর-সহ এমনকী নাটকবিশেষে ঘোড়ায় চড়িয়ে মঞ্চে প্রবেশ করানো হত। এবং এই ব্যাপারটি বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে বিজ্ঞাপিত হত। অথচ রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘রাজা’ নাটকে লিখলেন যে, ওই নাটকে রাজাকে মঞ্চে কোথাও দেখা যাবে না। নিঃসন্দেহে তিনি যুগের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলেন।
সে সময়ে গিরিশ ঘোষের ভক্তিরসের নাটকের প্লাবনে সারা বাংলা ভাসছিল। রবীন্দ্রনাথ সচেতন ভাবে তার প্রভাব থেকে নিজেকে দূরে রাখলেন। তিনি ভক্তিরসের উচ্ছ্বাস পরিহার করে তাঁর কয়েকটি নাটকে ভারতীয় বৈদিক দর্শনের ব্যঞ্জনা যোগ করলেন। দর্শনতত্ত্বের গভীর ব্যঞ্জনায় চরিত্রগুলি সূক্ষ্ম শিল্পসৃষ্টির নিদর্শন হয়ে রইল। এই রকম কয়েকটি চরিত্র তপতী, বিভা, ঠাকুর্দা, সুরঙ্গমা, ধনঞ্জয়, কুমুদিনী প্রভৃতি। এরা গৈরিক ভক্তিরসাত্মক চরিত্র নয়। তাই নাটকগুলি বৈদিক-দর্শনতত্ত্বের ভারে ভারাক্রান্ত হল না। অথচ দার্শনিক তত্ত্বটি নাটকে হৃদয়গ্রাহী শৈল্পিক রূপ পরিগ্রহ করল।
পরিশেষে রবীন্দ্রনাথের সংলাপ। তাঁর রূপক সাংকেতিক নাটকগুলির চরিত্রেরা রবীন্দ্রনাথের ভাষায় কথা বলে। কারণ, তারা তো ঠিক রক্তমাংসের মানুষ নয়, তারা তো বিশেষ বিশেষ ভাবের প্রতীক। কিন্তু তাঁর সামাজিক বা হাস্যরসের নাটকগুলিতে চরিত্ররা কথ্য ভাষাই ব্যবহার করে। উদাহরণস্বরূপ ‘রাজা ও রাণী’ নাটকে জনতার দৃশ্যের সংলাপ। এমনকী, রূপক-নাটক ‘রাজা’ ও ‘রক্তকরবী’-তেও জনগণের সংলাপ সাধারণ গদ্যে রচিত।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.