স্নেহ অতি বিষম বস্তু। বিশেষত রাজনৈতিক স্নেহ-র মতো বিপজ্জনক বস্তু এই পৃথিবীতে বেশি নাই। রাজনৈতিক স্নেহ যে কী অদম্য নৃশংসতার সহিত সভ্য, শিক্ষিত, কৃতী মানুষদের পাকে পাকে জড়াইয়া তাঁহাদের বিকৃত করিয়া ফেলে, নিঃশ্বাসের বিষবাষ্পে তাঁহাদের বোধ ও বুদ্ধি নিমেষে লোপ পাওয়ায়, এবং শেষ পর্যন্ত সংকীর্ণতা এবং মালিন্যের কর্দম তাঁহাদের গাত্রময় লেপন করিয়া দেয় তাহার উজ্জ্বলতম উদাহরণ, পশ্চিমবঙ্গ। রাজনীতির মাখোমাখো স্নেহে এই সব মানুষ মুহূর্তে ভুলিয়া যান তাঁহাদের কী কাজ করিবার ছিল। তাঁহাদের মনে কেবল জাগরূক থাকে একটিই ভাবনা: রাজনীতির এই স্নেহের কানন হইতে কী ও কোন্ প্রকার প্রসাদ তাঁহারা লাভ করিতে পারেন। সমগ্র ভারতেই রাজনীতির এই স্নেহ কখনও কখনও বুদ্ধিমার্গের যাত্রীদের দিকে ধাবিত হয়, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের কথাই আলাদা। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে ইহা সর্বদাই অঝোর ধারায় বর্ষণশীল, সৃজনশীলতা-নাশী কর্দম-রাজনীতি কলকলরবে প্রবহমান। ইহা কেবল বাঙালি রাজনীতির বিশেষত্ব ভাবিলে ভুল হইবে। ইহা বাঙালি বুদ্ধিচর্চার জগতেরও বিশেষত্ব বটে। তাঁহারা পুরস্কারের আশায়, প্রসাদের লালসায়, করুণাবিতরণী ‘কমিটি’-র ভরসায় সর্বদাই জোড়হস্ত। তবে ক্বচিৎ কিছু ব্যতিক্রম লক্ষিত হয় বটে। অতি সম্প্রতি শিল্পী শুভাপ্রসন্ন যখন পশ্চিমবঙ্গের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব জুরিডিক্যাল সায়েন্সেস-এর অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য হইতে অস্বীকার করিলেন, প্রদত্ত পদটি গ্রহণে অক্ষমতা প্রকাশ করিলেন, সেই মুহূর্তটি যেন তেমনই একটি ব্যতিক্রমী মুহূর্ত হিসাবে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল।
প্রশ্ন এই যে, কোনও শিল্পী কেন, কোন্ অধিকারে আইন-সম্পর্কিত অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য হইবেন। কিন্তু তাহা তো সাধারণ বুদ্ধির প্রশ্ন, বহির্জগতের প্রশ্ন, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি-জগৎ এই সব অবান্তর প্রশ্ন কিংবা উত্তরের ধার ধারে না। রাজ্য জুড়িয়া এমনই কমিটি-সমূহের শীর্ষ পদগুলি জুড়িয়া আছেন অনধিকারী তারকারা। ইঁহাদের অনেকেই অন্যান্য নানা ক্ষেত্রে কৃতী হইলেও যে পদগুলিতে তাঁহারা আসীন, তাহাতে তাঁহাদের এক ও একমাত্র অধিকার: স্নেহের অধিকার। রাজনৈতিক স্নেহের।
ইহা পশ্চিমবঙ্গের বিশেষত্ব। তবে জন্মগত নহে, এই বিশেষত্ব কষ্টার্জিত। কষ্টার্জিত, কেননা, চির কালই তো এইরূপ পরিস্থিতি ছিল না। সময়ের সহিত ক্রমে ক্রমে বাঙালি রাজনীতি ও বাঙালি সৃজন-বিশ্ব এই অসামান্য স্নেহগরলধারার বন্ধনে পরস্পরকে জড়াইয়া লইয়াছে, হাত ধরাধরি করিয়া অবনমনের নিম্নতম বিন্দুর দিকে যাত্রা করিয়াছে। চার দশক আগে এই রাজ্যে এমনও এক সময় ছিল, যখন কখনও কখনও উচ্চাসনে নিযুক্ত হইতেন রাজনৈতিক কৃপাপ্রার্থীরা। বাম আমলে দেখা গেল, ‘কখনও কখনও’-র বদলে সর্বদাই কৃপাপ্রার্থীরাই সর্বাগ্রে, কিন্তু তাঁহাদের কৃপাভিক্ষার বিষয়টি প্রকট হইলেও যোগ্যতা লইয়া সচরাচর প্রশ্ন উঠিত না। কোনও ঐতিহাসিক কোনও ইতিহাস-গোষ্ঠীর নেতৃপদে প্রতিষ্ঠিত হইলে বোঝা যাইত তাঁহার দলমান্যতা প্রশ্নাতীত, কিন্তু ইতিহাসচর্চার অধিকারেও সম্ভবত কোনও সংশয় নাই। বাম-উত্তর পশ্চিমবঙ্গ কিন্তু পূর্বাপেক্ষা বহু গুণ অকুণ্ঠ, নির্দ্বিধ। এখানে বিষয়ে অধিকারের প্রশ্নটি সম্পূর্ণ বাতুলতা। একমাত্র প্রশ্ন: রাজনৈতিক নৈকট্য। স্নেহের নৈকট্য। গত দেড় বৎসর যাবৎ সকল উচ্চাসনে কেবল এই একটি অধিকারই বিবেচিত হইয়াছে আর সব তুচ্ছ! এই প্রসাদ বিতরণের সংস্কৃতিতে রাজনীতি অতি চমৎকার ভাবে অনুশীলিত হয়। তবে কিনা, সারস্বত চর্চা ও সৃজন-সংস্কৃতির সুস্থ, স্বাভাবিক উদ্যাপন এই পরিস্থিতিতে অসম্ভব। অবশ্য, সম্ভবত তাহা পশ্চিমবঙ্গের আরাধ্য বস্তুও নহে। এই রাজ্যের জনমানসে নিশ্চয়ই রাজনীতিকে বাদ দিয়া বিদ্যা, সংস্কৃতি, উৎকর্ষ ইত্যাদির কোনও প্রাসঙ্গিকতা নাই, তাই তাঁহারা সযত্নে এই উন্মার্গগামী রাজনীতিকে আপ্রাণ প্রশ্রয় দিয়া থাকেন। যস্মিন্ দেশে যদাচারঃ। ইহার মধ্যে দু-একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা দেখিলে বিস্ময়ে বাক্রোধ হয়। শিল্পীর পদগ্রহণ অস্বীকারের ফলে রাজ্যের শীর্ষ আইন বিশ্ববিদ্যালয়টিকে তাহার কাউন্সিলের জন্য আবার নূতন করিয়া নাম খুঁজিতে দেখা তেমনই এক বিস্ময়-মুহূর্ত। |