গর্জনে বর্ষণ হয়তো হয়। কিন্তু ফল মেলে না তাতে।
উৎসবের সময়ে রক্তসঙ্কট এড়াতে ঢাকঢোল পিটিয়েই রক্ত সংগৃহীত হয়েছে। তার থেকে প্লাজমা বা রক্তরস উৎপন্নও হয়েছে। কিন্তু যাঁদের জন্য এত আয়োজন, সেই রোগীদের ভাগ্যেই তা জুটল না। উৎপন্ন সমস্ত প্লাজমাই বয়ে গেল নর্দমা দিয়ে। রাজ্যের ‘মডেল ব্লাড ব্যাঙ্ক’ হিসেবে চিহ্নিত মানিকতলা ব্লাড ব্যাঙ্কে গত ১৫ দিন ধরে এমনটাই ঘটে চলেছে বলে অভিযোগ।
অভিযোগ, গত ২৮ অক্টোবর থেকে ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত ফেলে দেওয়া প্লাজমার পরিমাণ প্রায় ২৩৬০ ইউনিট! ২৮, ৩০, ৩১ নভেম্বর এবং ১, ৩, ৫, ৬, ৮, ৯ ও ১১ ডিসেম্বর তারিখে দৈনিক ১১০-৩০০ ইউনিট পর্যন্ত প্লাজমা ফেলে দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ব্লাড ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ বা স্বাস্থ্য দফতরের তেমন হেলদোল নেই বলেও অভিযোগ।
এত প্লাজমা ফেলে দেওয়া হচ্ছে কেন? ব্লাড ব্যাঙ্কে গিয়ে দেখা গিয়েছে, পরপর তিনটি প্রধান ডিপ ফ্রিজার খারাপ। কর্তৃপক্ষ বা স্বাস্থ্য ভবন, কারও সেগুলি সারানোর আগ্রহ নেই। অবশিষ্ট দু’টি ফ্রিজারে আগে থেকেই প্লাজমা সংরক্ষিত। প্লাজমা এক বছর পর্যন্ত ব্যবহারযোগ্য থাকে। সংরক্ষিত ওই প্লাজমার সিংহভাগেরই মেয়াদ ফুরোতে এখনও অনেক বাকি। তাই ফেলা যাচ্ছে না। রাখার জায়গার অভাবে নতুন করে সংগৃহীত সব প্লাজমাই ফেলে দিচ্ছেন কর্তৃপক্ষ।
ঘটনার কথা স্বীকার করে রাজ্যের ব্লাড ব্যাঙ্কগুলির দায়িত্বে থাকা রাজ্য এড্স প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ সংস্থার (স্যাক্স) প্রোজেক্ট ডিরেক্টর রেশমী কামাল বলেন, “যতটা প্লাজমা উৎপন্ন হচ্ছে, তত চাহিদা রাজ্যে নেই। প্লাজমা ভাল থাকার মেয়াদও অনেক দিন। তাই জমে যাচ্ছে। রাখার জায়গার সঙ্কট হচ্ছে।” তাই বলে এত কষ্টে সংগৃহীত এবং উৎপাদিত গুরুত্বপূর্ণ রক্তের উপাদান স্রেফ ফেলে দেওয়া হবে? ফ্রিজার ঠিক করা হচ্ছে না কেন? রেশমী বলেন, “তিনটে ফ্রিজার যে খারাপ, তা জানতাম না। নিশ্চয়ই ব্লাড ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিচ্ছেন।”
প্রশ্ন উঠছে জায়গার সঙ্কট নেই, এমন ব্লাড ব্যাঙ্কে অতিরিক্ত প্লাজমা পাঠানো হচ্ছে না কেন ? স্বাস্থ্যকর্তারাই স্বীকার করেছেন, এক ব্লাড ব্যাঙ্কের রক্ত বা তার উপাদান অন্য ব্যাঙ্কে পাঠানোর সরকারি প্রক্রিয়া এত জটিল এবং এত নথি চালাচালি করতে হয় যে, কেউ তার মধ্যে ঢুকতে চান না।
প্লাজমা অতিরিক্ত হলে উৎপাদন বন্ধ রাখা হচ্ছে না কেন? ব্লাড ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের যুক্তি, “জাতীয় এড্স নিয়ন্ত্রণ সংস্থার (ন্যাকো) কড়া নির্দেশ, প্রতিদিন সংগৃহীত রক্তের ৮০ শতাংশ থেকে প্লাজমা ও রক্তের অন্যান্য উপাদান তৈরি করতেই হবে।”
এখানেই ফের প্রশ্ন উঠেছে, কেন রক্তের উপাদান প্রস্তুতকারী কোনও সরকারি বা বেসরকারি সংস্থাকে অতিরিক্ত প্লাজমা বিক্রি করে আয় বাড়ানোর চেষ্টা করছে না স্বাস্থ্য দফতর? রেশমীর উত্তর, “বিনিময়-ব্যবসায় ঢোকা পরিকল্পনায় রয়েছে। প্লাজমার বিনিময়ে রক্তের ব্যাগ বা ইমিউনোগ্লোবিউলিন আনানো যেতে পারে। তবে এর জন্য দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। দরপত্র ডাকতে হবে। সময় লাগবে।” তত দিন কি এ ভাবেই মানিকতলা ব্লাড ব্যাঙ্কে প্লাজমা ফেলে দেওয়া হবে? অধিকর্তা সৌরীন্দ্রনাথ গুছাইতের কথায়, “এর উত্তর দিতে বাধ্য নই। আমরা নিজেরাই যা করার করব।”
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে অবশ্য খবর, ‘প্লাজমার চাহিদা নেই বলে অতিরিক্ত প্লাজমা ফেলে দিতে হচ্ছে’, ব্লাড ব্যাঙ্কের এই যুক্তি আদৌ ধোপে টিকছে না। কারণ অগ্নিদগ্ধ থেকে সিরোসিস অফ লিভার, সাপে কামড়ানো বা হিমোফিলিয়ার রোগী প্রত্যেকেরই প্রচুর প্লাজমা দরকার হয়। এপ্রিল-মে থেকে সাপে কামড়ানোর ঘটনা বেড়ে যায়। তখন প্লাজমার টানাটানি শুরু হয়। শীতকাল থেকে সঞ্চিত প্লাজমা তখন কাজে লাগে। স্বাস্থ্য দফতরের আশঙ্কা, এ ভাবে প্লাজমা ফেলা হতে থাকলে চরম সঙ্কট হবে গ্রীষ্ম ও বর্ষায়। গরিব রোগীদেরও বেসরকারি জায়গা থেকে ৮০০-১২০০ টাকা দিয়ে এক ইউনিট প্লাজমা কিনতে হবে।
স্বাস্থ্য দফতরের মুখপাত্র অসিত বিশ্বাস বলেন, “ফ্রিজ খারাপ বা প্লাজমা বাড়তি হচ্ছে, এটাই ব্লাড ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ আমাদের বা ন্যাকো-কে জানাননি। জানলে তবে তো নীতি স্থির হবে। এটা ওরা অন্যায় করেছেন।” |