সল্টলেক-হাওড়া ২১৫এ রুটের বাস। শুক্রবার বেলা তখন ১১টা।
এক জনের হাতে একটি খবরের কাগজ। অন্য জনের হাতে সরকারি সিলমোহর লাগানো একটি তালিকা। দু’জনেই সমানে চেঁচাচ্ছেন।
খবরের কাগজ হাতে বৃদ্ধ বলছেন, আগের ভাড়ার চেয়ে এক টাকা বেশি দেব। তার বেশি নেওয়া চলবে না। তাঁর সক্ষে অন্য যাত্রীরাও। উল্টো দিকে কন্ডাক্টর। তিনি সরকার অনুমোদিত ভাড়ার তালিকা হাতে নিয়ে বলছেন, “আমিও তো আরটিও-র সই করা তালিকা দেখাচ্ছি। তার চেয়ে কম ভাড়া নিতে পারব না।” কন্ডাক্টরের কথায় চটে লাল যাত্রীরা। “নেবেন না মানে! খোদ মন্ত্রী বলেছেন, এই ভাড়াই ঠিক হয়েছে। এই দেখুন খবরের কাগজ।”
মন্ত্রীর কথা শুনেও দমছেন না কন্ডাক্টর। তা দেখে শেষে এক বিচিত্র পথ নিলেন প্রতিবাদী যাত্রীরা। আগের ভাড়ার থেকে এক টাকা করে বেশি দিয়ে জড়ো করলেন কয়েনগুলি। তার পরে একটি ফাঁকা আসনে সেগুলি রেখে তাঁরা শোভাবাজারে নেমে গেলেন। হতভম্ব কন্ডাক্টরকে বলে গেলেন, “নিতে হয় নিন। এ বার থেকে এ ভাবেই ভাড়া দেব।”
পরের দৃশ্য ২৩৭ নম্বর বাসে। কন্ডাক্টারের সঙ্গে তারস্বরে চিৎকার জুড়েছেন এক মহিলা। তাঁর পাশে আরও জনা পাঁচেক যাত্রী। মিনমিন করে কন্ডাক্টর বলছেন, “নতুন ভাড়ার তালিকা আসেনি। কী করে কম ভাড়া নেব!” তাতেই রে রে করে উঠলেন যাত্রীরা, “ইয়ার্কি হচ্ছে! মন্ত্রী বলছেন, তাতেও হচ্ছে না? তালিকা দেখাচ্ছো!” কন্ডাক্টর তখনও বলার চেষ্টা করছেন, “এ বার গাড়ি চালানোই বন্ধ করে দেব।” তা শুনে প্রায় সকলেই বলে উঠলেন, “গাড়ি বের করলেন কেন?” এরই মধ্যে এক যাত্রী বললেন, “এর জন্য দায়ী সরকার। সরকারি তালিকায় অসঙ্গতির জন্যই গোলমাল। বাড়ছে যাত্রী ও কন্ডাক্টরের মধ্যে ঝগড়া।” |
বালিখাল-ধর্মতলা ৫৪ নম্বর বাসে আবার অন্য নাটক। সেখানে কোনও চেঁচামেচি নেই। শুধু কন্ডাক্টর ভাড়া চাইতেই এক বৃদ্ধ পাঁচ টাকার কয়েন ধরিয়ে মুখ ঘুরিয়ে রাখলেন জানলার দিকে। কন্ডাক্টর জানান, তাঁর ভাড়া হবে সাত টাকা। ঠান্ডা গলায় বৃদ্ধের জবাব, “সরকার বলেছে, চার টাকার ভাড়া পাঁচ টাকা হবে। তা-ই দিয়েছি।”
শুক্রবার দিনভর এমনই সব খণ্ডচিত্র দেখল কলকাতা। যার এক দিকে সরকার অনুমোদিত ভাড়ার তালিকা। অন্য দিকে শিল্পমন্ত্রীর ঘোষণা। এমন বিচিত্র সমস্যা এর আগে শহর কোনও দিন দেখেছে কি না সন্দেহ!
তবে আম কলকাতাবাসীর জন্য সুখবর, দিনভর মহাকরণে দফায় দফায় মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করলেন পরিবহণ সংক্রান্ত মন্ত্রিগোষ্ঠী, মুখ্যসচিব, পরিবহণমন্ত্রী এবং পরিবহণ সচিব। যার শেষে সন্ধ্যায় মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ মেনে ঘোষণা হল নতুন ভাড়ার তালিকা। কী রয়েছে সেই তালিকায়? ধন্দ দূর করে প্রতি ধাপে বাড়ানো হয় ১ টাকা করে ভাড়া। মহাকরণে এই ঘোষণা করেন পার্থবাবু। এবং যা করতে গিয়ে প্রকাশ্যেই তিনি অনাস্থা প্রকাশ করলেন পরিবহণ দফতরের বিজ্ঞপ্তির প্রতি। বললেন, “১ টাকার বেশি ভাড়াবৃদ্ধি মানছি না।” এর পরে তিনি বলেন, “পরিবহণ দফতর থেকে যে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছিল, তাতে কিছু অসঙ্গতি রয়েছে। প্রথম পর্যায়ে শুধু কলকাতার অসঙ্গতি দূর করলাম। জেলা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে অসঙ্গতি থাকলে তারও পরিবর্তন করব।” আজ, শনিবার থেকে নতুন ভাড়া কার্যকর হবে বলে জানান পার্থবাবু।
৩১ অক্টোবর নতুন ভাড়া ঘোষণার সঙ্গে বাম আমলের দূরত্বের স্তর বা স্টেজেও পুনর্বিন্যাস করেছিল রাজ্য পরিবহণ দফতর। ফলে নতুন ভাড়া কোনও কোনও ক্ষেত্রে ৩-৪ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যায়। এ দিন বাম আমলের স্তরেই ফিরল তৃণমূল সরকার। সরকারের ঘোষণায় ক্ষুব্ধ বাসমালিকরা। তাঁদের সংগঠন বেঙ্গল বাস সিন্ডিকেটের নেতা দীপক সরকার বলেন, “প্রতারিত হলাম। ডিজেলের দাম ৪৫% শতাংশ বেড়েছে। তার উপরে যন্ত্রাংশ রয়েছে। আমাদের দিকটা সরকার দেখল না।” অন্য বাসমালিক সংগঠন জয়েন্ট কাউন্সিল অফ বাস সিন্ডিকেটের নেতা সাধন দাস বলেন, “কোনও লাভই হল না। এ ভাবে গাড়ি চালানো যাবে না।” আজ, শনিবারই এই নিয়ে বাসমালিক সংগঠনগুলি আলোচনায় বসে পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করবেন। |