দৃশ্য ১: আগুন লেগেছে কাপড়ের দোকানে। সময়মতো খবর পেয়ে ইঞ্জিন নিয়ে দমকল কর্মীরাও হাজির। কিন্তু বাজারের সঙ্কীর্ণ রাস্তায় দমকলের গাড়ি ঢুকল না। শেষে দূরে ইঞ্জিন রেখে কর্মীরা বাজারে ঢুকে পাইপে জল নিয়ে এসে কোনওরকমে আগুন আয়ত্তে আনলেন। কয়েক মাস আগে পুরুলিয়া শহরের কাপড়গলির এই ঘটনা প্রমাণ করিয়ে দেয় আগুনের কাছে এখনও কত অসহায় পুরুলিয়ার বাসিন্দারা।
দৃশ্য ২: এমএসএ স্টেডিয়াম সংলগ্ন পুরসভার মার্কেট কমপ্লেক্সের অবস্থাও কম বিপজ্জনক নয়। এখানে যত্রতত্র প্রচুর বিদ্যুৎবাহী তারের কুণ্ডলি দেখা যায়। বিদ্যুতের শট্সার্কিট থেকে ওই বাজারে আগুন ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না পুরবাসী।
দৃশ্য ৩: পুরুলিয়া শহরের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠছে বহুতল আবাসন। কিন্তু দমকলের কাছে তার কতগুলি সম্পর্কে নকশা রয়েছে? দমকল কর্মীদের দাবি, ওই বহুতলগুলিতে কত বাসিন্দা থাকেন, কোথায় জলাধার রয়েছে, সিঁড়ি কোন দিকে, আপৎকালীন কোনও সিঁড়ি রয়েছে কি নাকোনও তথ্যই আবাসনগুলি থেকে তাঁদের দেওয়া হয়নি। ফলে ওই বহুতলগুলি সম্পর্কে দমকলকর্মীদের কাছে আগাম কোনও ধারণা নেই। ফলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে, তার মোকাবিলা করতে দমকল কর্মীদের বিপাকে পড়তে হবে। অথচ শহরের বুকে একের পর এক বহুতল উঠছে। শুধু তাই নয়, দমকল কর্মীদের দাবি, শহরের প্রায় কোনও হোটেল, লজ, রেস্তোরাঁতেও দমকল বিভাগের ছাড়পত্র নেই।
|
রাজ্য সরকারের দমকল বিধি অনুসারে এই অনুমতি নেওয়াটা বাধ্যতামূলক। অথচ তা মানা হচ্ছে না। এই নিয়ে দমকল ও পুরসভার মধ্যে চাপানউতোর শুরু হয়েছে। পুরুলিয়া দমকল কেন্দ্রের ওসি সুদীপ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “যেখানে সেখানে নির্মাণ কাজ হচ্ছে। কেউ দমকলের অনুমতি নিচ্ছে না। শহরের বাজার, হোটেল, বহুতলের কোনও নকশাও আমাদের কাছে দেওয়া হয়নি। নির্মাণের আগে দমকলের অনুমতি নিতে বাধ্য করাতে পারে পুরসভা। কিন্তু পুরুলিয়া পুরসভাকে এ ব্যাপারে উদ্যোগী হতে চিঠি দিয়েও কাজ হয়নি।”
পুরুলিয়ার পুরপ্রধান তারকেশ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “দমকলের কাছ থেকে চিঠি পেয়েছি। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমরা তাঁদের কী ভাবে সাহায্য করতে পারি চিঠিতে তা স্পষ্ট নয়। তবে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শীঘ্রই দমকল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমরা বৈঠকে বসব।”
দমকল সূত্রে জানা গিয়েছে, ১৯৫০ সালের রাজ্য সরকারের ফায়ার সার্ভিস আইনের ২০০৩ সালের সংশোধনী অনুসারে সমস্ত হোটেল, লজ, রেস্তোরাঁ, বড় বেসরকারি অফিস, নার্সিংহোম, গুদাম-সহ বাজারে অগ্নিনিবার্পন সংক্রান্ত ছাড়পত্র নেওয়ার কথা। দমকলের দাবি, কিন্তু সেই ছাত্রপত্র নেওয়া হয় না। অন্তত এক বছর আগে আমরি-র অগ্নিকাণ্ডের পরেও এ ব্যাপারে সচেতনতা তৈরি হয়নি। বাসিন্দাদের অভিজ্ঞতা, কাপড়গলির রাস্তা খুবই সঙ্কীর্ণ। ভিতরে কয়েকশো কাপড়ের দোকান রয়েছে। এই বাজারে মাঝেমধ্যেই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। কিন্তু এখানে অগ্নিনির্বাপনের কোনও ব্যবস্থা নেই। অথচ গায়ে গায়ে লেগে থাকা দোকানগুলিতে আগুন ছড়িয়ে পড়ার খুবই সম্ভাবনা রয়েছে।
পুরুলিয়া শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এই কাপড়ের বাজারটি শুধু শহরেরই নয়, জেলারও বৃহত্তম কাপড়ের বাজার। পুজোর মরশুমে সকাল থেকে রাত অবধি এই বাজারে থিকথিকে ভিড় থাকে। সুদীপবাবুর কথায়, “এই বাজার শহরের ‘হাইরিস্ক জোন’। অথচ আগুন নেভানোর তেমন পরিকাঠামো নেই।” স্থানীয় তৃণমূল পুরপিতা প্রদীপ মুখোপাধ্যায়ও স্বীকার করেছেন, “এই ঘিঞ্জি বাজারটির যা অবস্থা, তাতে হঠাৎ যদি কোনওভাবে আগুন লাগে, দাঁড়িয়ে দেখা ছাড়া সত্যিই উপায় থাকবে না।”
একই আশঙ্কা ব্যবসাসীদের মধ্যেও রয়েছে। বিমল মোহতা নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, “দোকানে তো প্রচুর কাপড় থাকে। আগুন লাগলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। আমরাও চাই অগ্নিনির্বাপণের একটা সুষ্ঠু ব্যবস্থা থাকুক। কিন্তু দমকল বা পুরসভা এ নিয়ে কোনও পরমর্শ দেয়নি।”
পুরুলিয়া জেলা হোটেল ও লজ মালিক সংগঠনের সম্পাদক কালীশঙ্কর দীক্ষিতও বলেন, “এমনতি কিছু অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জাম হোটেলগুলোতে থাকে। কিন্তু ঠিক কী রকম ব্যবস্থা থাকা দরকার, তা দমকল বা পুর কর্তৃপক্ষ জানালে ভাল হত। আমরাও সেই অনুযায়ী আগুনের মোকাবিলা করার মতো ব্যবস্থা নিতে পারতাম।” |