সংস্কৃতি যেখানে যেমন

পঞ্চরসেই আলকাপ দর্শন
১০ নভেম্বর প্রকাশিত চিঠির উত্তরে জানাইওস্তাদ ঝাঁকসার অনুরোধ ও আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে তাঁর সঙ্গে বড়দা ‘কাপ’-এ অভিনয় করেন। আলকাপের ‘কাপ’ ছাড়া অভিনয়ের সুযোগ আর কিছুতে নেই। কিন্তু আলকাপ সম্বন্ধে স্বচ্ছ ধারণা নেই বলেই পত্রলেখক প্রশ্ন তুলেছেন। ওই অভিনয়ের বিষয়টি নতুন কোনও সংযোজন নয়। কলকাতা ও মফস্সলের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত আলকাপ বিষয়ক প্রবন্ধে ওই অভিনয় প্রসঙ্গ আমি উল্লেখ করেছি। তাই পত্রলেখক আমার প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃতি তুলে দিতে পেরেছেন। পত্রলেখকের জানা দরকার যে, ১৯৪০ থেকে ৫০ দশকের প্রতিযোগিতামূলক ‘পাল্লা’র জন্য অন্য দলের কোনও অভিজ্ঞ ও সুদক্ষ ‘অভিনেতা’ কিংবা ‘কপে’ কিংবা ‘ছোকরা’-কে আমন্ত্রণ জানানো বা ‘হায়ার’ করার রীতি আলকাপ দলে ছিল। সেক্ষেত্রে অভিনেতা বা কপে বা ছোকরা নিজেদের দলের অস্তিত্ব বজায় রেখেই ‘হায়ার’ অথবা আমন্ত্রিত হয়ে যেতেন অন্য দলের হয়ে পাল্লা লড়তে। বড়দা ওই রীতি মেনেই ওস্তাদ ঝাঁকসার আমন্ত্রণে ‘কাপ’-এ অভিনয়ের জন্যে ১৯৪৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে গিয়েছিলেন। ঝাঁকসা ‘হাতচিঠি’ পাঠিয়ে লোক মারফত আমন্ত্রণ জানালে অনুষ্ঠানের দিন বড়দা বাড়ি থেকে জঙ্গিপুরের মহম্মদপুরে এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে উঠতেন। সেখান থেকেই রাতে অনুষ্ঠান স্থলে উপস্থিত হন। আবার সেখান থেকেই আলকাপের অনুষ্ঠান শেষে মহম্মদপুর হয়ে খোশবাসপুরের বাড়িতে ফেরেন। এভাবেই যাতায়াত করে তিনি এক টানা নয়, কিছু দিন অন্তর ৫/৬ রাত্রি ‘কাপে’ অভিনয় করেন ওস্তাদ ঝাঁকসার দলের হয়ে। বড়দার কাছ থেকে যেমন ওস্তাদ ঝাঁকসা সম্বন্ধে জেনেছি, তেমনি পরে ঝাঁকসার সঙ্গেও আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ধনপতনগরের বাড়িতেও বেশ কয়েক বার গিয়েছি। গণেশপুরেও গিয়েছি দু’বার। শেষ বার গিয়েছিলাম ১৯৭৯ সালের ২৭ ডিসেম্বরে। বড়দার শিক্ষাদীক্ষা, অভিনয় ক্ষমতা ও কবিয়ালির দক্ষতা নিয়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন ওস্তাদ ঝাঁকসা। তাঁর সঙ্গে ‘কাপ’-এ ছটি পাল্লায় অভিনয়ের কথা তিনি বলেন। কিন্তু তাঁর বাড়িতে বড়দার থাকার কথা তিনি একবারও বলেননি। বরং তিনি এক দিন মহম্মদপুরের ইসফাকের সঙ্গে বড়দার পাল্লা’র দিন আসার কথা বলেছিলেন। ফলে ওস্তাদ ঝাঁকসার দলে ও বাড়িতে দাদার থাকার কষ্টকল্পিত। সেই সঙ্গে জানাই, আঙ্গিক ও প্রয়োগগত দিক থেকে আলকাপের একটা নিজস্ব বৈশিষ্ট ছিল। ওস্তাদ ঝাঁকসা ওই পরিবর্তন ঘটিয়ে যাত্রাধর্মী পঞ্চরসের সৃষ্টি করেন, যা আলকাপের তুলনায় বহুলাংশে কৃত্রিম। তবে আলকাপের পরিবর্তিত রূপ পঞ্চরস হলেও আলকাপ ও পঞ্চরসের মধ্যে সবক্ষেত্রেই পার্থক্য চোখে পড়ে। পঞ্চরসে প্রথম মহিলা শিল্পীর অনুপ্রবেশ ঘটে। সিরাজের ভাষায়“এখনও পঞ্চরস চলেছে। যাত্রার মত উঁচু তক্তপোষে আসর হয়। প্রবেশ-প্রস্থান আছে। নট-নটী মুখে রং মাখে। পরচুলা পরে। নকল দাড়ি-গোঁফ আঁটে। প্যান্ট-শার্ট-কোট-টাই-বুট জুতোও পরে। তাদের নাটকও বোম্বে ফিেল্মের উচ্ছিষ্ট।” কাজেই পঞ্চরসকে কোনও ভাবেই ‘আলকাপ’ বলা যায় না। ‘মায়ামৃদঙ্গ’ প্রকাশের পরেই এক শ্রেণির লোকসংস্কৃতি গবেষক আলকাপ সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। কিন্তু তত দিনে আলকাপের ‘অবলুপ্তি’ ঘটেছে। ফলে তাঁদের আলকাপ দেখার সুযোগ হয়নি। তাঁরা ‘পঞ্চরস’ দেখেই পরিকল্পিত ভাবে আলকাপ বলে চালানোর চেষ্টা করেন।


শিল্পী কখন পরাধীন হন
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের স্মৃতিচারণায় তুলসীচরণ মণ্ডলের পত্রের প্রেক্ষিতে উষ্মাজারিত সৈয়দ খালেদ নৌমানের চিঠি পড়লাম। নৌমানের দাবি, সিরাজ কোনও দিন ঝাঁকসুর দলে আড়বাঁশি বাজননি। ওই তথ্য প্রতিষ্ঠা করতে নৌমানের যুক্তি হাস্যকর। তাঁর যুক্তি, একটি আলকাপের আসরে সিরাজের কাছে ঝাঁকসু পরাজয় স্বীকার করেছেন, সুতরাং সিরাজ কেন ‘পরাধীন ভাবে’ ঝাঁকসুর দলে বাঁশি বাজাবেন? অথচ বিভিন্ন শিল্পীর সমন্বয়ে গড়ে ওঠে শিল্পের গণমাধ্যম। প্রতিটি শিল্পীর স্বতস্ফূর্ত নৈপুণ্য প্রদর্শনের মধ্য দিয়েই রচিত হয় সেই শিল্পের সাফল্যের সোপান। বিভিন্ন শিল্পীর মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য চায় একজন নির্দেশক। কারওর নির্দেশনায় কাজ করলেই কি একজন শিল্পী ‘পরাধীন’ হয়ে যান? তা ছাড়া ঝাঁকসুর ওই পরাজয় স্বীকার শিল্পী হিসাবে তাঁর দীনতা নয়, বিনয়েরও পরিচয় হতে পারে। খালেদের দ্বিতীয় দাবি, ঝাঁকসুকে অকারণে ‘আলকাপ সম্রাট’ বানিয়ে সিরাজকে হেয় করা হয়েছে। হতে পারে আলকাপ শিল্পী হিসাবে সিরাজ ঝাঁকসুর চেয়ে উৎকর্ষে এগিয়ে ছিলেন। কিন্তু সেটিই কি যথেষ্ট? নৌমান নিজেই জানিয়েছেন, যৌবনের প্রারম্ভে সিরাজ আলকাপ ছেড়ে সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন। অথচ যাঁকে আলকাপ সম্রাট বলায় আপত্তি সেই ঝাঁকসু আমৃত্যু (৮৩ বছর বয়সে তিনি পরলোক গমন করেন) চরম দারিদ্রের মধ্যেও ওই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁর দুই মেয়েই আলকাপের প্রথম মহিলা শিল্পী। মুর্শিদাবাদ ছাড়িয়ে বর্ধমান, মালদহ, রাজশাহি এমনকী বিহারেও তাঁর অনন্য প্রতিভার বিস্তার ঘটে। আলকাপকে জনপ্রিয় করে তোলার পাশাপাশি এটিকে সর্বজনীন রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে ঝাঁকসুর নাম সর্বাগ্রে উল্লেখের দাবি রাখে। মহাজনী শোষণ (তোর টাকা লিবে কেটা/তোর মুখে মারি ঝাঁটা) থেকে পরাধীনতার যন্ত্রণা (বাংলা মা তুই কাঁদবি কত কাল/ তোর সোনার অঙ্গ করল ভঙ্গ, রক্ত ধারায় লালে লাল) বা, সম্প্রদায়িক সম্প্রীতি (হিন্দু যারে জল বলে মুসলমানে কয় পানি/ হিন্দু যারে দিদিমা বলে মুসলামানে কয় নানি)-সহ প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর ছিল অবাধ বিচরণ। আলকাপকে মার্জিত ও পরিশিলীত ভাষায় পরিবেশনের মাধ্যমে একটি যথার্থ লোকনাট্যে উন্নীত করার ক্ষেত্রে ঝাঁকসুর অবদান অনস্বীকার্য। শ্রদ্ধেয় সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজকে হেয় করা নয়, গুণী শিল্পীর মূল্যায়নই এই পত্রের মূল প্রতিপাদ্য।


১৩৮৩ সালের ২৭ বৈশাখ
গত ১৩ অক্টোবর প্রকাশিত খালেদ সৈয়দ নৌমানের পত্রে। তিনি জানতে চেয়েছেন, ‘‘কবে কোনও অনুষ্ঠানে মিলিত হয়ে ঝাঁকসাকে ‘আলকাপ সম্রাট’ উপাধি প্রদান করেছেন জানলে বাধিত হব।” তারই উত্তরে জানাই ওস্তাদ ঝাঁকসাকে প্রদত্ত মানপত্রের ‘জেরক্স’ রয়েছে। ওই মানপত্র বাংলা ১৩৮৩ সালের ২৭ বৈশাখ বহু বিদগ্ধজনের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রদান করা হয়। ওই অনুষ্ঠানে আলকাপপ্রেমীজনের মধ্যে ছিলেন ডঃ দিলীপ ঘোষ, অধ্যাপক আশিস রায়, শিক্ষক হরিলাল দাস, শিক্ষক নিমাই সাহা, বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব বরুণ রায় প্রমুখ। দ্বিতীয়ত, ১৯৮৫ সালের ২২ জুন সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত দেবাশিস দাসগুপ্ত (ছবি সংগ্রাহক তন্ময় কর্মকার)-এর লেখা প্রবন্ধ ‘বন্দেগি জাঁহাপনা’-র ‘জেরক্স’ পাঠালাম। সিরাজের জীবদ্দশাতেই ওই প্রবন্ধে লেখা হয়েছে, ‘‘সিরাজ ঝাঁকসুর দলেও ছিলেন’’। ওই প্রবন্ধেই লেখা রয়েছে, ‘‘আগে আলকাপের নাম ছিল ‘ছ্যাঁচড়া গান’। ওস্তাদ ঝাঁকসু প্রবর্তন করলেন আলকাপ গানের।” তৃতীয়ত, ১৯৮৭ সালের ৬ জুন আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত প্রখ্যাত সাংবাদিক বিক্রমন নায়ারের লেখা ‘চাঁই সমাজের মানুষরা তপশিল ভুক্তির জন্য ঝুঁকছে কেন?’ দেবাশিস দাসগুপ্ত ও বিক্রমন নায়ার দু’ জনেই সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের হাতচিঠি নিয়ে রঘুনাথগঞ্জ ডাকঘরে আমার কাছে আসেন। চতুর্থত, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ আলাদা করে ‘দেশ’ সাপ্তাহিকে ওস্তাদ ঝাঁকসুর উপরে লিখেছেন। এ গুলির তথ্য প্রমান বলে যে, ঝাঁকসুর জীবন ও চাঁই সমাজের সঙ্গে সিরাজ ওতপ্রোত ভাবে জড়িত ছিলেন। পঞ্চমত জানাই, নিরক্ষর একজন মানুষ-- ওস্তাদ ঝাঁকসুর কৃতিত্ব, কবিত্ব, সাহিত্য, নাটকের স্বীকৃতি দিলে ও মেনে নিলে ক্ষতি কি!



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.