পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপ্রাণী কী? প্রশ্নটির জবাব দিতে গিয়ে হোঁচট খেয়েছেন স্বয়ং রাজ্যের বনমন্ত্রী হিতেন বর্মণ। পরে দফতরের কোনও অফিসারের কাছ থেকে জেনে বলেন, ‘বাঘরোল’। স্বয়ং বনমন্ত্রীর স্মৃতিতে ফিকে হয়ে আসা এ হেন প্রাণীদের অবস্থা সঙ্কটজনক হওয়াটাই স্বাভাবিক। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা-রিপোর্টও বলছে একই কথা।
ডব্লিউডব্লিউএফ-এর তত্ত্বাবধানে প্রাণিবিজ্ঞানের গবেষক ত্বিষা আঢ্য হাওড়া ও হুগলি জেলায় বাঘরোলদের উপর সমীক্ষা চালান। আর তাতেই উঠে আসে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপ্রাণীর দুর্দশার ছবি।
এ রাজ্যে বাঘরোল লোকালয়ের কাছাকাছি জঙ্গল ভরা জলা জায়গায় থাকে। সুন্দরবনেও প্রচুর বাঘরোলের বাস। কিন্তু বাড়িঘর তৈরি, ইটভাটা এবং চাষের জন্য জলাভূমি ভরাট হয়ে যাওয়ায় টান পড়ছে বাঘরোলের খাদ্যে। ওই মাংসাশী প্রাণী তাই গৃহস্থের বাড়িতে হানা দিয়ে হাঁস, মুরগি, ছাগল ছানা টেনে নিয়ে যায়। ক্ষুব্ধ গৃহস্থ সুযোগ পেলেই পিটিয়ে মারেন বাঘরোল। |
সরকারি তরফে অবশ্য রাজ্যপ্রাণীর এ হেন দুর্দশা নিয়ে চিন্তা-ভাবনার বেশ অভাব। যেমন এখানে বাঘরোলের সংখ্যা কত, তা জানেনই না রাজ্যের বনদফতরের মুখ্য আধিকারিক সীতাংশুবিকাশ মণ্ডল। কারণ কোনও দিনই বাঘরোলের গণনা হয়নি। সীতাংশুবাবুর সাফ কথা, “ছোট প্রাণী গণনা করি না।” তিনি জানান, মানুষের আক্রমণে কোনও বাঘরোল আহত হলে তাকে উদ্ধার করেন বনদফতরের কর্মীরা। ওই প্রাণী যেহেতু কোনও সংরক্ষিত অরণ্য বা জাতীয় উদ্যানে বাস করে না, তাই তাদের সুরক্ষার দায় নেই বন দফতরের। অথচ বাঘরোল বিপন্নতার এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজার্ভেশন অফ নেচার (আইইউসিএন) তাকে ইতিমধ্যেই ‘বিপজ্জনকভাবে বিপন্ন’ হিসেবে লাল তালিকাভুক্ত করেছে।
সেই বিপন্নতার ছবিটাই সমীক্ষা রিপোর্টে পেশ করেছেন ত্বিষা। হাওড়া এবং হুগলীতে সর্বাধিক পতিত জলাভূমি থাকায় সমীক্ষার জন্য এই দুটি জেলাকেই বেছে নেন তাঁরা। মূলত জেলাদু’টির বড় বড় বিল এবং জলাভূমি লাগোয়া ৩৪টা গ্রামকেই এ কাজে ব্যবহার করেন তাঁরা।
সেখানে প্রায় তিনশো মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়ে, বাঘরোলের পায়ের ছাপ তুলে, বিষ্ঠা পরীক্ষা করে এবং লুকোনো ক্যামেরায় ছবি তুলে ওই প্রাণীর বর্তমান অবস্থা, জীবনযাপন বোঝার চেষ্টা করেছেন ত্বিষারা। এ কাজে তাঁদের সাহায্য করেন আমতা থানার সারদা গ্রামের প্রসাদতীর্থ জনকল্যাণ সমিতির সদস্যরা। সমীক্ষকদের কাছ থেকে ক্যামেরা এবং প্রশিক্ষণ নিয়ে তাঁরা গ্রামের বাইরে লুকোনো ক্যামেরা পেতে রাখেন, মাঝে মাঝে বাঘরোলের ছবিও ওঠে। ওই ছবির সূত্র ধরে বাঘরোল গণনাও শুরু করা হবে বলে জানান ত্বিষা।
সমীক্ষা বলছে, বাঘরোল মোটেও ভয়ঙ্কর হিংস্র প্রাণী নয়। বাংলাতে তার দুটো মিষ্টি নামও আছে মাছবাঘা আর মেছোবিড়াল। নাম থেকেই স্পষ্ট, বাঘরোলের প্রধান খাদ্য মাছ। তারা জলের পাখিও শিকার করে থাকে। ত্বিষা অবশ্য বলছেন, “ডানকুনি, ডোমজুড়, গড়চুমুক, সারদা, কুশবেড়িয়া এবং আইমা গ্রামে খড়ি আর হোগলার জঙ্গলে বাঘরোলের বাস। তবে চাষে ব্যবহার করা কীটনাশকের প্রভাবে জলাভূমিগুলির মাছ আর শামুক প্রায় শেষ। তাতে বাঘরোলের খাবারে টান পড়ায় লোকালয়ে হানা দিচ্ছে। উদ্বেগের বিষয়, গড়চুমুক অঞ্চলে নদীর পাড়ে জলাভূমিগুলোতে ইটভাটা হয়ে যাওয়ায় সেখানে আবাস হারাচ্ছে তারা।” সরকার এখনও জলাভূমি রক্ষায় ব্যবস্থা না নিলে শীঘ্রই রাজ্যপ্রাণী কেবল সরকারি নথিতেই থেকে যাবে।
সমীক্ষার পাশাপাশি বাঘরোল হত্যার বিরুদ্ধে সচেতনতা বাড়ানোর প্রচারও চালান তাঁরা। তাতে কিছুটা কাজও হয়েছে। প্রসাদতীর্থ জনকল্যাণ সমিতির সদস্য রঙ্গলাল মহিশ বলেন, “বাঘরোল পিটিয়ে মারার প্রবণতা ধীরে ধীরে কমছে।” ওই সমীক্ষক দলের এক সদস্য পার্থ দে মনে করেন, “গ্রামের মানুষ এত দিন ধরে বাড়ির হাঁস, মুরগি আর ছাগল ছানা খুইয়েও সব বাঘরোল মেরে ফেলেননি। মানতেই হবে, বাঘরোল এখনও বিলুপ্ত না হওয়াটা গ্রামের মানুষের সহনশীলতারই প্রমাণ।”
তিনিই জানালেন, ধানের চাষ ক্রমশ অলাভজনক হওয়ায় এলাকায় খড়ির চাষ বাড়ছে। খড়ি ঠিক চাষ নয়, জলা জমি ফেলে রাখলেই সেখানে খড়ি জন্মায়। যা দেখে একাংশের প্রশ্ন, শেষমেশ কি তাহলে খড়ি চাষের অর্থনীতিই বাঁচিয়ে রাখবে অযত্নে থাকা রাজ্যপ্রাণীকে? |