শুধু পৌরাণিক কাহিনী নয়। ‘থাকা’র আকর্ষণ বাড়াতে এ বার ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’, বিক্রম বেতাল’ নিয়েও পালা করলেন কাটোয়ার কার্তিক পুজোর উদ্যোক্তারা। এমনকী পুরাণ নিয়ে এ বছর যে সব থাকা তৈরি হয়েছে, নতুনত্ব রয়েছে তাতেও।
শুক্রবার থেকে শুরু হয়েছে কার্তিক পুজো। চলবে দু’দিন। এই পুজোর অন্যতম আকর্ষণ ‘থাকা’। যা আসলে পিরামিডের মতো দেখতে একটি বাঁশের কাঠামো, যেখানে থাকে -থাকে সাজানো থাকে মাটির পুতুল। সেই সব পুতুল দিয়েই পুরাণের বিভিন্ন গল্প ফুটিয়ে তোলা হয়। এছাড়া কার্তিকের সঙ্গে অন্য দেব -দেবীরাও পূজিত হন। অন্য দিকে, আধুনিক মণ্ডপসজ্জার মাধ্যমে দেবসেনাপতির আরাধনাও করেন পুজো উদ্যোক্তাদের একাংশ।
এক দিকে থিম পুজো, অন্য দিকে বড় বড় মূর্তি গড়ে কার্তিক আরাধনার চাপে থাকা তার নিজস্বতা হারাচ্ছিল বলে দাবি লোক গবেষকদের একাংশদের। কাটোয়ার লোক গবেষক পাঁচুগোপাল বক্সীর মতে, “পুরাণের একঘেয়ে বিষয় আর সাজানোর পদ্ধতির মধ্যে কোনও নতুনত্ব না থাকায় থাকার আকর্ষণ নতুন প্রজন্মের কাছ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।” |
পুজো উদ্যোক্তাদের দাবি, শোভাযাত্রায় যোগদানকারী ৮৬টি পুজোর মধ্যে ২০১০ সালেও ২৪টি থাকা থাকত। গত বছর তা নেমে দাঁড়ায় ১৮টিতে। বছর তা এক ধাক্কায় কমে দাঁড়িয়েছে ন’টিতে।
‘থাকা’ সাজানো বন্ধ করে দিয়েছে, এমন পুজো কমিটির সদস্য তরুণ ঘোষ, সনাতন সাহারা বলেন, “থাকার আকর্ষণ কী ভাবে বাড়ানো যায়, সে ব্যাপারে কোনও নতুন চিন্তা মাথায় আসছিল না। তাই থাকার পরিবর্তে কৃষ্ণমূর্তি পুজো করছি।”
আবার ‘থাকা’তে নতুন চিন্তার যোগান দিচ্ছে কাটোয়া শহরের গোয়ালপাড়ার প্রতিবাদ, শাঁখারিপট্টি সবর্জনীন। প্রতিবাদ ক্লাব এ বছর থাকার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছে ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’। সেখানে দেখা গিয়েছে, গুপী -বাঘার গ্রাম থেকে বিতাড়িত হয়ে জঙ্গলে আশ্রয় নেওয়া থেকে ভূতের রাজার সঙ্গে দেখা হওয়ার মজার মজার গল্প। শব্দের কারসাজিতে শোনা গেল, ‘ভূতের রাজা দিল বর ... ’। কিছুুটা দূরেই শাখাঁরিপট্টি। তারা থাকা সাজিয়েছে বিক্রম -বেতালের গল্প নিয়ে। এখানে নীতি গল্প ‘প্রকৃত বন্ধু’র কাহিনী শোনা যাবে। গোয়ালপাড়ার বাসিন্দা নিত্যগোপাল গোস্বামীর নির্দেশনাতেই থাকার সজ্জায় ‘পরিবর্তন’ এসেছে। নিত্যগোপালবাবুর দাবি, “পুরনো কাহিনীতে কোনও বৈচিত্র্য আনা যেত না। একঘেয়েমি কাটাতে শিশুদের পছন্দের বিষয় নিয়ে থাকা সাজানো হয়েছে।”
কাছারি রোডের ঝঙ্কার ক্লাব অবশ্য এ বারও পুরাণের উপরেই নির্ভরশীল। তবে তারা এ বছর পুতুল বানিয়ে থাকার ভিতরেই ‘দৃশ্যাঙ্কন’ করেছে। ওই ক্লাবের সম্পাদক কালী চট্টরাজের দাবি, “প্রতি বছরই থাকায় নতুনত্ব আনার চেষ্টা করি। আগামী বছর আমরা পুরাণ ছেড়ে আধুনিক বিষয় নিয়ে থাকা সাজাব।”
কাটোয়ার কার্তিক পুজোর ইতিহাস প্রায় তিনশো বছরের পুরনো। লোক গবেষকদের মতে, ভাগীরথীর তীরে চুনারিপাড়ায় (অধুনা হরিসভাপাড়া ) গড়ে উঠেছিল ‘বন্দর’। সেখানে বড় বড় ব্যবসায়ীরা নদীতীরে বজরা লাগিয়ে রাত কাটাতেন। ওই বন্দর ঘিরে গড়ে উঠেছিল যৌনকর্মীদের আস্তানা। সেখান থেকেই কার্তিক পুজোর শুরু। তার পরে শহরে ‘বাবু’ সম্প্রদায়ের লোকজন এই পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। বাবুদের কার্তিক পুজো ঘিরে উন্মাদনা থেকেই শুরু হয় ‘কার্তিক লড়াই’।
কাটোয়া মহকুমার ইতিহাস ও সংস্কৃতির গবেষক স্বপন ঠাকুর বলেন, “গুপ্ত যুগেও কাটোয়ায় কার্তিক পুজোর প্রমাণ মিলেছে। তবে কার্তিক নিয়ে উন্মাদনার সূত্রপাত শহরে বাবু -সংস্কৃতি আসার পর থেকে।”
|