ভোর পাঁচটা। টালা পার্কের নির্জন রাস্তায় হাউহাউ করে কাঁদছেন এক প্রৌঢ়া। রক্তে মুখ ভেসে যাচ্ছে। আশপাশের লোক ছুটে এলে বছর পঞ্চাশের গৃহবধূ জানালেন, তিনি প্রাতর্ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। একটা ছেলে তাঁকে মারধর করে কানের দুল ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছে।
দুপুর আড়াইটে। চিনার পার্কের এক লন্ড্রিতে দাঁড়ানো এক প্রৌঢ়ার গলার হারে হ্যাঁচকা টান, পরক্ষণে জোর ধাক্কা। রাস্তায় ছিটকে পড়লেন মহিলা। কিছু বোঝার আগে দেখলেন, হার হাতিয়ে মোটরবাইকে চেপে চম্পট দিচ্ছে দুই যুবক।
সোমবার কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে মহানগরে ফের জোড়া ছিনতাইয়ের ঘটনা দেখিয়ে দিল, ছিনতাই-রাজে আদৌ রাশ পড়েনি। বরং কাকভোরে পথচলতি মহিলা তো বটেই, ভরদুপুরে দোকানে দাঁড়িয়ে থাকা প্রৌঢ়াও যে ভাবে তার শিকার হলেন, তাতে ছিনতাইকারীদের বেপরোয়া ভাব আরও প্রকট। কাউকে ধরতেও পারেনি পুলিশ। উপরন্তু দেখা গেল, দক্ষিণ কলকাতা ও লাগোয়া শহরতলির গণ্ডি ছাড়িয়ে ছিনতাইয়ের দাপট ছড়িয়ে পড়েছে উত্তরেও। তবে বিধাননগর কমিশনারেটের অধীন চিনার পার্কে মোটরবাইকে চেপে ‘পরিচিত কায়দায়’ রাহাজানি হলেও কলকাতা পুলিশের চিৎপুর থানা-এলাকার টালা পার্কে ‘পদব্রজে ছিনতাই’ পুলিশকে ধাঁধায় ফেলেছে। গোয়েন্দারা এখনও বুঝতে পারছেন না, দু’টি একই দলের কাজ কি না।
পুলিশ জানায়, টালা পার্কের ওই মহিলার নাম ঊর্মিলা সেন। দুষ্কৃতীর মারে তাঁর মুখ-ঠোঁট-নাক ফেটে গিয়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসা হয়েছে। আর চিনার পার্কের মহিলার নাম লতা জৈন। ধাক্কায় পড়ে গিয়ে তিনিও চোট পেয়েছেন। ঠিক কী হয়েছিল এ দিন?
পুলিশ-সূত্রের খবর: ১০/৩/এইচ উমাকান্ত সেন লেনের বাসিন্দা ঊর্মিলাদেবী রোজকার মতো এ দিন ভোরে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন। বাড়ির আধ কিলোমিটার দূরে তাঁদের কয়লার দোকান। সেখানে গিয়ে কর্মচারীদের ঘুম থেকে তুলে তিনি বাড়ি ফেরেন। ঊর্মিলাদেবী পুলিশকে জানিয়েছেন, এ দিন পাড়ার মোড়ে কালো জ্যাকেট পরা অচেনা একটা ছেলের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। সে তাঁকে শুধোয়, ‘ভাবি, কোথায় যাচ্ছেন?’ দোকানের দিকে যাচ্ছেন শুনে সে বলে, ‘চলুন, আমিও ওই দিকে যাব।’
ঊর্মিলাদেবীর অভিযোগ, ছেলেটি তাঁর পাশে পাশে হাঁটতে শুরু করে। বার বার গায়ে ধাক্কা দিতে থাকে। বিপদ বুঝে তিনি বাড়ির দিকে দৌড় লাগান, কিন্তু ছেলেটি বাঁ হাতে তাঁর চুলের মুঠি টেনে ধরে। টান মারে কানের দুল ধরে॥
আর এ সবের মধ্যে তাঁর এক ভরি সোনার দুলজোড়া ছিনিয়ে নিয়ে ছেলেটি চম্পট দেয় বলে পুলিশকে জানিয়েছেন ঊর্মিলাদেবী। স্থানীয় বাসিন্দা দেবিকা ভট্টাচার্য বলেন, “সবে ঘুম থেকে উঠেছি। হঠাৎ জোরে কান্নার আওয়াজ। বেরিয়ে দেখি, বৌদির সারা মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছে, হাউহাউ করে কাঁদছেন। একটা ছেলে গলি থেকে বেরিয়ে নর্দার্ন অ্যাভিউয়ের দিকে পালাচ্ছে।” দেবিকাদেবী চেঁচিয়ে লোকজন ডাকেন। ঊর্মিলাদেবীকে আরজিকরে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানে তাঁর মুখে সাতটি সেলাই পড়ে। চিৎপুর থানায় গিয়ে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন ঊর্মিলাদেবীর স্বামী সুরেন্দ্র প্রসাদ। এ দিন গিয়ে দেখা গেল, বাড়ির সামনে পড়শিদের ভিড়। ঊর্মিলাদেবী ঘরে শোওয়া, মুখের অনেকটা ফুলে গিয়েছে। যন্ত্রণায় ভালো করে কথা বলতে পারছেন না। কোনও মতে বললেন, “আমাকে খুব মারল। ওকে যেন পুলিশ ধরে শাস্তি দেয়।” সুরেন্দ্রবাবু বলেন, “আজ ও বেরোনোর কিছু ক্ষণ পরে শুনি, বাইরে চেঁচামেচি হচ্ছে। দেখি, পাড়ার লোক ওকে রক্তাক্ত অবস্থায় ধরে নিয়ে আসছে।”
|
আহত ঊর্মিলা সেন। |
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, ক’মাস আগেও ওই তল্লাটে দিনে-রাতে, কখনও মোটরবাইকে, কখনও বা সাইকেলে চেপে পুলিশ টহল দিত। এখন তার বালাই নেই। মহিলাদের অভিযোগ, একটা বড় ঝিলের ধারে বাইরের ছেলেরা দিন-রাত আড্ডা জমায়, নেশা করে। “উৎপাতে পাড়ার মেয়েদের চলাফেরা করা দায়। এ বার তো ঘর থেকে বার হতেই ভয় করবে!” মন্তব্য করেন স্থানীয় বাসিন্দা মহুয়া ভট্টাচার্য। পুলিশ কী বলে?
মোটরবাইকে চেপে না-এসে পায়ে হেঁটে এ হেন ছক ভাঙা ছিনতাইয়ে কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে তারা। কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা-প্রধান পল্লবকান্তি ঘোষ বলেন, “সাম্প্রতিক কালে বিভিন্ন ছিনতাইয়ের সঙ্গে এর মিল নেই। দেখা হচ্ছে, কারা জড়িত থাকতে পারে।”
কয়েক ঘণ্টা পরে বাগুইআটি থানার চিনার পার্কে অবশ্য গত ক’মাসের ধারাই বজায় রেখেছে দুষ্কৃতীরা। সেখানকার এক আবাসনের বাসিন্দা লতাদেবী জানিয়েছেন, বেলা আড়াইটে নাগাদ তিনি বেরিয়েছিলেন লন্ড্রির জামাকাপড় আনতে। দোকানে দাঁড়ানো অবস্থাতেই তাঁর গলায় হ্যাঁচকা টান লাগে, আচমকা ধাক্কায় উল্টে পড়েন। “দেখলাম রোগা, কালো একটা ছেলে সোনার হারটা নিয়ে মোটরবাইকের পিছনে বসে পালিয়ে গেল। বাইক চালাচ্ছিল যে, তার মুখ হেলমেটে ঢাকা।” বলেন লতাদেবী। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, তাঁরা চোর-চোর বলে চেঁচালেও ওদের ধরা যায়নি। মোটরবাইকটি তীব্র বেগে তেঘরিয়ার দিকে চলে যায়। এক মার্বেলের দোকানের কর্মীর কথায়, “আগে সন্ধের দিকে এখানে ছিনতাই হয়েছে। দিনে-দুপুরে এই প্রথম!”
স্বভাবতই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন লতাদেবী। হাতের কব্জিতে কালশিটে পড়ে গিয়েছে। গলাও জখম। স্থানীয় দোকানিরা তাঁর প্রাথমিক চিকিৎসা করেছেন। পুলিশের দাবি, ওখানে নিয়মিত পুলিশি টহল থাকে। তবু এমন কাণ্ড কেন, পুলিশের কাছে তার ব্যাখ্যা মেলেনি। বিধাননগর কমিশনারেটের এডিসি সন্তোষ নিম্বলকর বলেন, “তদন্ত শুরু হয়েছে। দেখা হচ্ছে, এর পিছনে কোনও দল রয়েছে কি না।” একের পর এক ছিনতাইয়ের জেরে রাজ্য প্রশাসনও তোপের মুখে। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র এ দিন বলেন, “আজও দু’টো ছিনতাই হয়েছে! এখন তো ছিনতাই সকালেও হয়, দুপুরেও হয়, বিকেলেও হয়।”
যত দিন ছিনতাই-চক্র ধরা না পড়ে তত দিন কী হবে? মেয়েরা কি গয়না পরে পথে বেরোবেন না? পুলিশ কমিশনার রঞ্জিত পচনন্দা আশ্বাস দিচ্ছেন। আতঙ্কিত না হয়ে স্বাভাবিক জীবনযাত্রাই চালু রাখতে বলছেন। এ দিনই তিনি সব বিভাগীয় কমিশনারের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সকালের দিকে শহরের বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ বাড়ানো হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। পচনন্দার বক্তব্য, পরপর ছিনতাইয়ের ঘটনাগুলোয় একেবারে কেউ ধরা পড়েনি এমন নয়। তদন্তের স্বার্থেই মুখ খুলছে না পুলিশ।
|