বাণিজ্যিক কাজে লাগাতে রাজ্যের হাতে থাকা জমি নিলাম করে বণ্টনের পরিকল্পনা করছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। সম্প্রতি টুজি স্পেকট্রাম মামলায় বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে প্রাকৃতিক সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে নিলাম-পদ্ধতির বৈধতা শিরোধার্য করেছে সুপ্রিম কোর্ট। তারই ভিত্তিতে রাজ্যের এই নতুন ভাবনা বলে জানিয়েছেন সরকারের এক মুখপাত্র।
তবে সুপ্রিম কোর্ট এ-ও বলেছে, সব প্রাকৃতিক সম্পদ যে নিলাম করেই বিলি করতে হবে, সংবিধানে এমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। বরং কোন সম্পদ কী ভাবে বণ্টন করা হবে, পরিস্থিতি অনুযায়ী সরকারেরই তা স্থির করা উচিত। মহাকরণের খবর: খাস জমি বিলি প্রসঙ্গে শীর্ষ আদালতের এই বক্তব্যটিও মাথায় রাখা হচ্ছে। দেখা হচ্ছে, নির্বিচার নিলামই যেন একমাত্র পথ হয়ে না-ওঠে।
মুখপাত্রটি জানান, পশ্চিমবঙ্গে প্রাকৃতিক গ্যাস ও খনিজের সম্ভার কম। প্রাকৃতিক সম্পদ বলতে সরকারের হাতে রয়েছে মূলত জমি। যাচাই করা হচ্ছে, শিল্প-বাণিজ্যিক বিবিধ উদ্দেশ্যসাধনে সেই জমি কী ভাবে নিলাম ডেকে হস্তান্তর করা যায়। সরকারের হাতে থাকা সব জমিই নিলাম হবে কি না, হলে সব ধরনের প্রকল্পের জন্য হবে, নাকি জনস্বার্থের প্রকল্পকে বাদ রাখা হবে এ সব খুঁটিনাটি নিয়ে আলোচনা চলছে। গোটা বিষয়টির দায়িত্বে রয়েছেন রাজ্যের মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, মুখ্যসচিবের নেতৃত্বে কয়েক জন সচিবকে নিয়ে একটা কমিটি হয়েছে। পুজোর আগে সচিবদের সঙ্গে সঞ্জয়বাবুর এক দফা আলোচনাও হয়ে গিয়েছে। বাণিজ্যিক লক্ষ্যে জমি বণ্টনের সামগ্রিক নীতি প্রণয়নের চেষ্টার পাশাপাশি কমিটি নিলাম-পরিকল্পনার একটা রূপরেখা বানাবে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। চূড়ান্ত পরিকল্পনায় রাজ্য মন্ত্রিসভার অনুমোদন লাগবে। |
নিলাম ডেকে বেসরকারি হাতে সরকারি জমি তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে রাজ্যে কার্যত পথিকৃৎ হল হিডকো। সংস্থাটি গত প্রায় দেড় দশকে নিউটাউনের জন্য কয়েক হাজার জমি অধিগ্রহণ করেছে। আর তার একটা বড় অংশ বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে লটারি ও নিলামের মাধ্যমে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারও এখন সেই পথে হাঁটতে চাইছে বলে জানিয়েছেন সরকারি মুখপাত্র। কিন্তু যে রাজ্যে বড় শিল্প করার জন্য সরকার একলপ্তে বেশি জমির ব্যবস্থা করতে পারে না, জমি ব্যাঙ্ক গড়েও যেখানে সমস্যার সুরাহা হয়নি, সেখানে নিলামে জমি কিনতে লগ্নিকারীরা কতটা আগ্রহী হবেন?
মুখপাত্রের ব্যাখ্যা, “শিল্পের জন্য জমির সমস্যাটি ভিন্ন বিষয়। ঠিক যেমন বেসরকারি ও যৌথ উদ্যোগের প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ না-করার সিদ্ধান্তের ব্যাপারটাও আলাদা। আপাতত নিলামে জমি বিলির একটি অভিন্ন নীতি তৈরির চিন্তা-ভাবনা চলছে।” এতে আইনি কোনও বাধা থাকবে না তো? মুখপাত্রটি জানান, পশ্চিমবঙ্গে সেচ, পূর্ত, নগরোন্নয়ন, শিল্প, প্রাণিসম্পদ, মৎস্য, কৃষি দফতরের হাতে বেশি পরিমাণ জমি রয়েছে। ভূমি দফতরের হাতে রয়েছে সবচেয়ে বেশি জমি। সাধারণত কোনও দফতর বা সংস্থা জমি নিলাম করতে চাইলে আইনগত অসুবিধে থাকার কথা নয়। কিন্তু ভূমি দফতর জমি নিলামে তুলতে চাইলে তাদের আইন সংশোধন করতে হবে।
এ দিকে পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নতুন সরকারের গড়া ‘জমি ব্যাঙ্ক’ সম্পর্কে এ পর্যন্ত প্রকাশিত তথ্য বলছে, সরকারের হাতে থাকা ফাঁকা জমির পরিমাণ কমবেশি ৬০ হাজার একর। এর মধ্যে বিভিন্ন দফতরের পাশাপাশি জেলাশাসকদের হাতের জমিও রয়েছে। কিন্তু ভূমি দফতরের অনুমান, এই হিসেবের বাইরেও বিভিন্ন দফতরের অধীনে বেশ কিছু জমি থেকে গিয়েছে। মহাকরণের এক কর্তার কথায়, “বিভিন্ন প্রকল্পের নামেও দফতরগুলোর হাতে বিস্তর জমি আছে। অথচ বহু জায়গায় কোনও কাজ হয় না। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, হয়তো ফাঁকাই পড়ে রয়েছে!”
পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে এই জাতীয় ‘পড়ে থাকা’ খাস জমিও ভবিষ্যতে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে নিলামে উঠতে পারে। প্রশাসনের খবর, বাণিজ্যিক কারণে খাস জমি বণ্টনে সাধারণত তিন ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করা হয় রাজ্যে। হিডকো-র মতো সংস্থা পেশাদারি ভাবে জমি নিলাম করে। রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগম বা কেএমডিএ নিলাম না-করলেও বাজারদরে জমি লিজ দেয়। আবার কিছু দফতর ও সংস্থা ‘জনস্বার্থের’ কারণ দেখিয়ে কার্যত জমি দান-খয়রাতি করে বলে অভিযোগ। “নানা পদ্ধতিকে একত্রিত করে রাজ্য এ বার অভিন্ন পদ্ধতি আনতে চাইছে। এতে জমি বণ্টনে স্বচ্ছতাও বজায় থাকবে, কোষাগারে আয়ও বাড়বে।” মন্তব্য করেন সরকারের এক কর্তা। |