বিজয়া থেকে বিজয়া। এক বছর। শিল্প নিয়ে প্রশ্ন চিহ্ন কিন্তু কাটেনি।
গত বছর বিজয়ার পর শিল্পপতিদের সঙ্গে বসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। উদ্দেশ্য, শুভেচ্ছা বিনিময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজ্য নিয়ে লগ্নিকারীদের উৎসাহের পারদ মেপে নেওয়া। শিল্পায়নের সমস্যা কাটাতে ক্ষমতায় আসার পরে শিল্পমহলের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেই কোর কমিটি গড়ার কথাও ঘোষণা করেছিলেন তিনি। এক বছর পরে আজ ফের বিজয়া উপলক্ষে শিল্পমহলের মুখোমুখি হচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। তার আগে দীর্ঘ বিরতির পরে বৃহস্পতিবার ২৪ ঘণ্টার নোটিসে ডাকা হয়েছিল কোর কমিটির বৈঠক। তাতে কোনও আলোচ্যসূচিও ছিল না। সরকারের এই মনোভাব নিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে শিল্পমহলে।
হলদিয়া থেকে দুবরাজপুর সাম্প্রতিক কালে শিল্প ক্ষেত্রে একের পর এক গন্ডগোল দেখেছে রাজ্য। যা নিয়ে শিল্পমহলের উদ্বেগ রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ শিল্পোন্নয়ন নিগমের ভবনে কোর কমিটির বৈঠকে কিন্তু সেই সব প্রসঙ্গ নিয়ে কোনও আলোচনাই হয়নি। কথা হয়েছে মূলত হলদিয়ায় আসন্ন ‘বেঙ্গল লিডস’ শিল্প সম্মেলন নিয়ে। রাজ্য সরকারের নিজস্ব উদ্যোগে আয়োজিত এই সম্মেলনে লগ্নিকারীদের টানতে বণিকসভাগুলির সহযোগিতা চেয়েছেন শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়।
এ দিন আরও দু’টি বিষয় নিয়ে কথা হয়েছে কোর কমিটির বৈঠকে। রাজ্যের নয়া শিল্পনীতি এবং হলদিয়ায় পরিবেশ সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় নিষেধাজ্ঞা। তথ্যপ্রযুক্তি নীতির পরে এ বার নয়া শিল্প নীতি তৈরি করছে রাজ্য সরকার। শিল্পমন্ত্রী জানান, খসড়া তৈরির কাজ প্রায় শেষ। অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র বিদেশ থেকে ফিরে এলেই তা নিয়ে আলোচনা হবে। এই শিল্পনীতি আকর্ষণীয় করে তুলতে বৈঠকে উপস্থিত বণিকসভার প্রতিনিধিদের কাছে পরামর্শ চেয়েছেন পার্থবাবু। তবে একই সঙ্গে বুঝিয়ে দিয়েছেন, জমি নিয়ে রাজ্য সরকারের নীতি বদলাবে না। সেটা মাথায় রেখেই পরামর্শ দিতে হবে।
পাশাপাশি বৈঠকে শিল্পমন্ত্রী জানান, হলদিয়ায় কেন্দ্রীয় সরকারের পরিবেশ সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞার ফলে মার খাচ্ছে লগ্নি। তাঁর অভিযোগ, কেন্দ্রকে বিষয়টি বিবেচনা করার আর্জি জানিয়েও এখন পর্যন্ত কোন কাজ হয়নি। এই সমস্যার সমাধানসূত্র খুঁজতে শিল্পমহলের সাহায্য চান পার্থবাবু। বেঙ্গল চেম্বার অফ কমার্স জানিয়েছে, হলদিয়ায় পরিবেশ নিয়ে আইআইটি-র মতো প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে একটি রিপোর্ট তৈরির পরিকল্পনা করা হচ্ছে। তাতে বাস্তব পরিস্থিতি তুলে ধরা হবে। বিশেষজ্ঞদের তৈরি রিপোর্টের ভিত্তিতে কেন্দ্রের কাছে সওয়াল করা সহজ হবে বলে মনে করছে এই বণিকসভা।
কিন্তু এ রাজ্যে শিল্পায়ন নিয়ে লগ্নিকারীদের মূল যে মাথাব্যথা, সেই জমি আর পরিকাঠামো নিয়ে কোনও আলোচনা না এগনোয় শিল্পমহলের একাংশ হতাশ। তাঁদের মতে, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম কাণ্ড যে সমস্যা সামনে এনে দিয়েছে, তার কোনও সমাধান হচ্ছে না। আর সেটা না হলে রাজ্যে শিল্পায়নের সমস্যা সুদূর পরাহত। রাজ্য সরকারের উচিত জরুরি ভিত্তিতে এ নিয়ে আলোচনা করে সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে বের করা। একমাত্র তা হলেই বোঝা যাবে শিল্পায়ন নিয়ে রাজ্য আগ্রহী।
নতুন রাজ্য সরকার অবশ্য এখন তৃণমূলের ইস্তাহারে ঘোষিত জমিনীতিতেই অনড়। গত বছর বিজয়া উপলক্ষে শিল্পপতিদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর আলাপচারিতায় এই প্রসঙ্গ উঠেছিল। তখনই মুখ্যমন্ত্রী স্পষ্ট জানিয়েছিলেন জমি অধিগ্রহণ নিয়ে তাঁর দলের অবস্থান থেকে তিনি সরবেন না। শিল্পপতিদের নিজেদেরই জমি কিনে শিল্প করতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে যেখানে জমি বহু মালিকানায় বিভক্ত, সেখানে নিজ উদ্যোগে জমি কেনা যে কতটা অসুবিধার, সেটা বহু বার বহু শিল্পপতি বলেছেন। প্রশ্ন উঠেছে, সেই ঝঞ্ঝাট কেন তাঁরা পোহাতে যাবেন।
সরকারের পরামর্শ পুরুলিয়ার মতো প্রত্যন্ত এলাকায়, যেখানে খাস জমি রয়েছে, বা জমি সহজলভ্য, সেখানে শিল্প গড়ে উঠুক। শিল্পপতিরা জানিয়েছিলেন, রাস্তা ও অন্যান্য পরিকাঠামো সরকার তৈরি করে দিলে প্রত্যন্ত এলাকায় যেতেও তাঁদের আপত্তি নেই। কিন্তু তা-ও মানতে চাননি মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর যুক্তি ছিল, বিনিয়োগের পাশাপাশি ব্যবসার প্রয়োজনীয় পরিকাঠামোও শিল্পপতিরাই গড়ে নিন। গত এক বছরে এই অবস্থান থেকে নড়েননি মমতা।
আগামী দিলেও সরকার যে এই অবস্থান বদলাবে না, নয়া শিল্পনীতির খসড়া থেকেও তা স্পষ্ট। এই নীতি তৈরি করতে শিল্পমহলের কাছে পরামর্শ চেয়েছে রাজ্য। কিন্তু একই সঙ্গে এ-ও বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, বিশেষ আর্থিক অঞ্চল ও জমি অধিগ্রহণ নিয়ে রাজ্যের অবস্থান মাথায় রেখেই পরামর্শ দিতে হবে।
সরকারি সূত্রে বলা হচ্ছে, শিল্পপতিদের কাছ থেকে শুধুই নিয়মকানুনের ছাড় বা আর্থিক সুবিধার দাবিদাওয়া সংক্রান্ত কথা শুনতে চাইছে না রাজ্য। শিল্পের সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে কোথায় কী ঘাটতি আছে এবং তা ভরাট করতে কী করা দরকার, সে ব্যাপারে পরামর্শ চায় সরকার। লগ্নির অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে কী ধরনের কৌশল প্রয়োজন, সে বিষয়েও বণিকসভাগুলির বক্তব্য জানতে চায় রাজ্য। আগামী দশ দিনের মধ্যে তাদের মতামত জানাতে বলা হয়েছে। |