শ্মশানকালী পুজোর মাথায় মমতা, চিন্তায় পুলিশ
|
শ্মশানকালীর পুজোয় মুখ্য উপদেষ্টার ভূমিকায় এ বার স্বয়ং তিনি।
কেওড়াতলা মহাশ্মশানের গায়ে গত ১৫ দিন ধরে ঝুলছে একটি বিশাল হোর্ডিং। তাতে শ্মশানকালী পুজোর প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে লেখা আছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম। নতুন এই কমিটিতে স্থানীয় কাউন্সিলার, ডোমেদের একাংশ এবং এলাকার বাসিন্দারা ব্রাত্য হয়ে গিয়েছেন বলে অভিযোগ। তা নিয়ে এলাকায় ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। গোয়েন্দা রিপোর্টে সে কথা উল্লেখ করে রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরকে এই পুজোয় ঢালাও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে।
কেওড়াতলা মহাশ্মশানের এই পুজোটি আগে ছিল কখনও শ্মশান-স্বপন কখনও বা শ্রীধর দাসদের দখলে। (সত্যজিৎ রায়ের শেষকৃত্যের সময়ে কেওড়াতলা শ্মশানে গন্ডগোল করার অভিযোগ উঠেছিল ওই দু’জনের বিরুদ্ধেই) পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০০৪ সালে বিসর্জনের সময় প্রতিমা পুড়ে যায়। তার জেরে এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে পুজো উদ্যোক্তাদের ব্যাপক গোলমাল বাধে। ফলে হস্তক্ষেপ করতে হয় পুরসভাকে। পুরসভার হস্তক্ষেপে পণ্ডিতদের বিধান মেনে ২০০৪-এর ডিসেম্বরে পুজো করা হয়। পরের বছর শ্মশানে কমর্রত ডোম এবং অন্য কর্মীদের হাতেই পুজোর দায়িত্ব তুলে দেয় পুরসভা। ঠিক হয়, স্থানীয় কাউন্সিলার কংগ্রেসের মালা রায়ের তত্ত্বাবধানে তৈরি হবে পুজোর কমিটি।
সেই থেকে এই পুজো হয় কলকাতা পুরসভার তত্ত্বাবধানে। পুরসভাই পুজোর কমিটি অনুমোদন করে। দু’বছর আগে পর্যন্ত এটি মালা রায়ের পুজো বলেই খ্যাত ছিল। মালা রায় অবশ্য বলেন, “তৎকালীন মেয়র বিকাশ ভট্টাচার্যের নির্দেশের প্রেক্ষিতে এত দিন শ্মশানের কর্মী ও ডোমেরাই মূলত পুজোটি করতেন। আমি সাহায্য করতাম।”
গত বার এই পুজোর সঙ্গে যুক্ত হন স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। এ বার মমতা নিজে। আর কমিটি থেকে ছেঁটে দেওয়া হয়েছে মালা রায়ের নাম। স্থানীয় সূত্রের খবর শ্মশানের যে সব ডোম এবং পাড়ার যাঁরা এত দিন পুজোটি করে আসছিলেন, বাদ পড়েছে তাঁদের নামও। নতুন কমিটিতে এসেছেন রাজ্যের একাধিক মন্ত্রী, মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় এবং মুখ্যমন্ত্রীর ভাই কার্তিক বন্দ্যোপাধ্যায়। |
কেওড়াতলা মহাশ্মশানে কালী পুজোর হোর্ডিং। —নিজস্ব চিত্র |
কেন বাদ পড়লেন মালা রায়েরা? তৃণমূলের তরফে এই পুজো ঘিরে দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হয়েছে। তার জেরেই এ বার মালা বাদ পড়েছেন বলেও তাদের দাবি। মালার বক্তব্য, “সবই সাজানো ঘটনা।”
পুজো কমিটির এ বারের সভাপতি শোভনদেববাবু বলেন, “দলের নির্দেশেই পুজোর দায়িত্ব নিয়েছি। কলকাতা পুরসভা কমিটি গড়ে দিয়েছে। কারও নাম বাদ দিলে পুরসভাই দিয়েছে।”
কলকাতার শ্মশানগুলি রয়েছে পুরসভার স্বাস্থ্য বিভাগের অধীনে। মেয়র পারিষদ স্বাস্থ্য অতীন ঘোষ বলেন, “গত বছর থেকেই আমরা স্থানীয় বিধায়ককে কমিটি গড়া এবং পুজোর অন্য সব দায়িত্ব দিয়েছি। ওঁরাই কমিটি গড়েছেন। আমি শুধু সই করেছি।” মালা রায় প্রসঙ্গে অতীনের মন্তব্য, “সহসভাপতি পদে তো ওঁর নাম আছে বলে মনে হচ্ছে। আমি তো সে রকমই দেখলাম।”
কেওড়াতলা শ্মশানের গায়ে যে বিশাল হোর্ডিং ঝুলছে, তাতে কিন্তু কোথাও মালার নাম নেই। তাঁর বক্তব্য, “গত বছর থেকে এলাকার বিধায়ক জোর খাটিয়ে পুজোর দখল নিয়েছেন। গত বছর তা-ও স্থানীয় কাউন্সিলার হিসেবে আমাকে বা সিপিএমের দু-এক জনকে কমিটিতে রাখা হয়েছিল। এলাকার লোকজনও কেউ কেউ ছিলেন। এ বার আর কাউকে ডাকা হয়নি। ডোমেদের অধিকাংশই পুজোর বাইরে।” মুখ্যমন্ত্রীকে পুজো কমিটির মাথাতেও বসতে হবে কেন, সেই প্রশ্নও তুলেছেন মালা।
শ্মশানকালীর পুজোয় ডোমেরা বাইরে কেন? শোভনদেববাবুর উত্তর, “বয়স্ক ডোমেরা আমাদের সঙ্গে রয়েছেন। কিছু বাচ্চা ছেলে গোঁ ধরে আসেনি। কেউ কেউ ওদের উস্কানি দিচ্ছে বলে খবর পেয়েছি।”
কিন্তু এই পুজো নিয়ে চিন্তায় পড়েছে পুলিশ। শ্মশানকালীর পুজোয় এমনিই যথেষ্ট ভিড় হয়। তা ছাড়া, ওই পুজো ঘিরে অশান্তির ইতিহাসও রয়েছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়কে পাঠানো কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের যুগ্ম কমিশনার পার্থসারথি ঘোষের রিপোর্ট। সেই রিপোর্টে বলা হয়েছে, এ বারের পুজোয় স্থানীয় বাসিন্দারা ব্রাত্য বলে অভিযোগ। ডোমেদের বড় অংশ ক্ষিপ্ত বলে জানা গিয়েছে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী নিজে এই পুজো কমিটির মাথায় রয়েছেন, তাঁর ভাই কমিটির সদস্য হয়েছেন। ফলে বিষয়টি স্পর্শকাতর হয়ে গিয়েছে। গত বছর জগদ্ধাত্রী পুজোর বিসর্জনে যে ভাবে মুখ্যমন্ত্রীর পাড়ার ছেলেরা জড়িয়ে পড়েছিলেন এবং মুখ্যমন্ত্রী রাতে থানায় ছুটে গিয়েছিলেন, তা-ও মনে করিয়ে দিয়েছে গোয়েন্দা বিভাগ।
রিপোর্ট পেয়ে স্বরাষ্ট্র দফতরের কর্তারা বেশ চিন্তিত। মহাকরণ সূত্রে বলা হয়, মুখ্যমন্ত্রী নিজেই জড়িত ভেবে ওই রিপোর্ট আর তাঁর কাছে পেশ করা হয়নি। মহাকরণ থেকে লালবাজারে নির্দেশ পাঠিয়ে বলা হয়েছে, কেওড়াতলায় এ বার নিরাপত্তার কোনও ফাঁকফোঁকর যেন না থাকে। নিরাপত্তা দিতে হবে পুজো কমিটির কর্তাদেরও। স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তা বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী নিজেই পুজো কমিটির মাথা। ফলে সেখানে গোলমাল হলে তো প্রশাসনের মুখ পুড়বে। সেই কারণেই বাড়তি সতর্কতার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।” |