ভিড়াক্রান্ত রোমের সিস্টিন চ্যাপেল।
যেন হাজার হাজার বছর পিছিয়ে যাওয়া। যেন মুহূর্তের মধ্যে চোখের সামনে ভেসে ওঠা জলজ্যান্ত ইতিহাস। ইউরোপের শিল্প-সংস্কৃতি-সাহিত্যের রেনেসাঁস। ঘটনাস্থল, পোপের বাড়ি, রোমের সিস্টিন চ্যাপেল। যার চতুর্দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মাইকেলেঞ্জেলো, সান্দ্রো বোত্তিচেলি, পেত্রো পেরুগিনোর মতো শিল্পীদের দেওয়ালচিত্র। যার টানে প্রতি বছর ভিড় করেন লক্ষ লক্ষ পর্যটক। আর এই ভিড়ের চাপেই এখন ‘হাঁসফাঁস’ অবস্থা ভ্যাটিক্যানের।
পাঁচশো বছর বয়স হল সিস্টিন চ্যাপেলের। ১৪৮২ সালে দেওয়াল জুড়ে আঁকা মাইকেলেঞ্জেলোর ছবি। তার কোথাও ধরা পড়েছে যিশুর জীবন, কোথাও আবার ঈশ্বর স্বয়ং নেমে এসেছেন অ্যাডামের কাছে। এ সব শিল্পকীর্তি দেখতেই প্রতি দিন গড়ে ২০ হাজার পর্যটক জড়ো হন চ্যাপেলে। বছরের হিসেবে ৫০ লক্ষ। ভ্যাটিক্যানের মতে, প্রতি দিনের ঠাসাঠাসি ভিড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এত পুরনো বহুমূল্য ছবিগুলো। শুধু ভ্যাটিক্যানই নয়, একই কথা বলছেন সমলোচকরাও। চ্যাপেলের অবস্থা দেখে এক ইতালীয় সাহিত্যিক সম্প্রতি লিখেছিলেন, ‘অকল্পনীয় দুর্ভোগ’। তিনি আরও লেখেন, “ভিড়ের মধ্যে কেউ কিছু দেখতেই পাচ্ছেন না। দমবন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো। একে অন্যের গায়ে ঠেসাঠেসি করে দাঁড়িয়ে। ঘামের গন্ধে ভয়াবহ।” |
অবস্থা যে সত্যিই শোচনীয়, মেনে নিয়েছেন, ভ্যাটিক্যান মিউজিয়ামের ডিরেক্টর আন্তোনিও পাউলোচি। তাই এ বার থেকে পর্যটকের সংখ্যাও নিয়ন্ত্রণের চিন্তা-ভাবনা করছেন তাঁরা। তা ছাড়া হাওয়া চলাচল-ব্যবস্থারও উন্নতি করা হচ্ছে।
কিন্তু পর্যটক-নিয়ন্ত্রণ কী করে সম্ভব? শুধু রেনেসাঁস যুগের শিল্পকলাই তো নয়, পোপের বাড়িতে গিয়ে পূণ্য করার সুযোগও খোঁজেন অনেকে। ভ্যাটিক্যানের এই দাবির পিছনে আবার পয়সার ঝনঝনানি শুনতে পাচ্ছেন সমলোচকেরা। চ্যাপেলে ঢোকার মাথাপিছু টিকিটের দাম ১৫ ইউরো, টাকার অঙ্কে ১০৫১ টাকা। তবে, এরও বিকল্প বাতলে দিয়েছেন তাঁরা। সে ক্ষেত্রে সিস্টিন চ্যাপেলের এক ঝলক মেলাই হয়তো আরও দামি হয়ে যাবে।
মারা যাওয়ার কিছু দিন আগেই শিল্প-সমলোচক রবার্ট হিউস ২০০ বছর আগে এক জার্মান সাহিত্যিকের সিস্টিন-ভ্রমণের কথা লিখেছিলেন “এক এক জন জিনিয়াসের মহান সৃষ্টি, আর তার মাঝে তুমি একা দাঁড়িয়ে।” অদ্ভুত অনুভূতি, যা এখন ভাবাও অবাস্তব, নিজের লেখায় আক্ষেপ করেছিলেন রবার্ট। তাঁর কথায়, ছবি আঁকা হল এক নিঃশব্দ-শিল্প, যা অনুভব করতে গেলেও নিস্তবদ্ধতার প্রয়োজন আছে। কিন্তু এখন সে সব কোথায়? একটা ছোট্ট গল্প বলেছিলেন তিনি দুই বন্ধু সিস্টিন চ্যাপেলে গিয়েছেন। মাইকেলেঞ্জেলো ছবি দেখে প্রথমে তাঁরা বিস্ময় প্রকাশ করেন। পর মুহূর্তে এক জনের কৌতুক, মাইকেলেঞ্জেলো যদি এখন আঁকতেন, তা হলে তিনি কত দাম পেতেন! এর পরে তাঁরা তারস্বরে হাসতে শুরু করেন।
নিজের হাতের জাদুতে পঞ্চদশ শতাব্দীতে চ্যাপেলের দেওয়ালে এক ঐশ্বরিক অনুভূতি নামিয়ে এনেছিলেন মাইকেলেঞ্জেলো। “এখন সেই মহান শিল্প-সংস্কৃতির শবদেহ পড়ে রয়েছে ওখানে”, আক্ষেপ রবার্টের। |