নিলয় দাস • দলমোড় (বীরপাড়া) |
বন্ধ চা বাগানে শ্রমিকদের মৃত্যু মিছিল চলছেই। তালিকায় নাম ডুয়ার্সের ঢেকলাপাড়া বাগানের বিচ লাইনের এক শ্রমিক পরিবারে চিকিৎসার অভাব, অপুষ্টিতে ভুগে সোমবার মারা গেলেন জগাইন নাইক (২২)। তাঁর জন্ডিস হয়েছিল। সপ্তাহ খানেক বীরপাড়া স্টেট হাসপাতালে থাকার পর মারা যান ওই যুবক।
বন্ধ দলমোড় চা বাগানে ৩ মাসে মারা গিয়েছেন অন্তত ৭ জন। যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের দিন কাটে বুনো কচু, শাকপাতা খেয়ে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসা মিলছে না, মিলছে না একশো দিনের কাজ। শিশুরা স্কুল ছেড়ে দিয়ে যাচ্ছে পাথর ভাঙতে, কচু তুলতে। বাগানের প্রায় বারশো পরিবারের চরম দুর্দশার খবরই নেই জেলাশাসক কিংবা শ্রমমন্ত্রীর কাছে। ‘প্রকৃত ঘটনা’ জানতে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন তাঁরা।
মৃত্যুকে যেন শিয়রে নিয়ে ঘরের দাওয়ায় শুয়ে সোনামতি বানিয়া। চা বাগানের শ্রমিক বস্তি বড়া লাইনে থাকেন তিনি, বাগানে পাতা তোলার কাজ করতেন। সংসারে সত্তরোর্ধ্ব মা শান্তি দেবী, আর মানসিক রোগগ্রস্ত বোন দুলকি। তিন মাস আগে বাগান বন্ধের পর প্রথমে কিছু দিন নদীতে পাথর ভেঙে সোনামতি দু’বেলা আধপেটা খাবার জুটিয়েছেন। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ার পর বৃদ্ধা মা বনের থেকে কচু, শাকপাতা এনে সেদ্ধ করে খেয়ে বেঁচে রয়েছেন। শান্তি দেবীর কথায়, “মাস খানেক আগে সরকার যে চাল দেয় তা ফুরিয়েছে। ধুমচি জঙ্গল আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে।”
|
অসুস্থ সোনামতি বানিয়া। ছবি: রাজকুমার মোদক। |
স্বামীর মৃত্যুর পর পর বাগান বন্ধ হওয়ায় বৃদ্ধা শাশুড়ি মাংরি দেবী ও দুই মেয়েকে নিয়ে অথৈ জলে পড়েন পুনাই-এর স্ত্রী নির্মলা। চরম দুরবস্থায় ওই বধূ মাসখানেক আগে দালালের হাত ধরে দিল্লি পাড়ি দেন। নাতনিদের নিয়ে এখন ভোর হলে মাংরি দেবী পাগলিঝোরাতে পাথর ভাঙতে যান। টাকার অভাবে জয়চরণ নাইক তাঁর মেয়েকে ডাক্তার দেখাতে পারেননি। ফুলবন্তির চিকিৎসা করে গ্রামের ওঝা। ১৩ অক্টোবর মারা যায় ফুলবন্তি। সন্তান শোকের সময় নেই জয়চরণের। অন্য মেয়ে দুর্গি, স্ত্রী বিফাইনকে নিয়ে তিনি ভোরে জঙ্গলে কচু খোঁজেন।
ডুয়ার্সের দলমোড় বাগান বন্ধের খবর পেলেও সেখানে যে শ্রমিকরা চরম দুরবস্থায় মৃত্যুর দিকে এগোচ্ছেন, তা জানেন না শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু। তিনি বলেন, “দলমোড়বাগানে মৃত্যু নিয়ে জেলা প্রশাসন আমাকে কিছু জানায়নি। কেউ যাতে অপুষ্টিজনিত বা অনাহারে মারা না যান, সে দিকে কড়া নজর রাখার জন্য প্রশাসনের কর্তাদের জানিয়েছি। এ ছাড়াও, প্রকৃত ঘটনা জানতে অফিসারদের তদন্তের নির্দেশ দিয়েছি।” জলপাইগুড়ির জেলাশাসক স্মারকী মহাপাত্র বলেন, “ওই বাগানে মৃত্যুর ঘটনা আমার জানা নেই। খোঁজ নেব। তবে টাকা না-থাকায় কিছুদিন ১০০ দিনের কাজ বন্ধ ছিল। শীঘ্রই তা চালু হবে।”
ওই বাগানে হাসপাতাল রয়েছে। বাগান বন্ধ থাকলেও হাসপাতাল চালু রাখা বাধ্যতামূলক। কিন্তু, তা দৈনিক আধ ঘণ্টার বেশি খোলা থাকে। বাগানের নথি অনুযায়ী, তিন মাসের মধ্যে, সুজি বড়া (৩৬), ফ্রান্সিস ওরাওঁ (৫৬), সবিনা ওরাওঁ (৫২), সন্তু ধানোয়ার (২৭), চৌথী ওরাওঁ (৬২) রামু মুন্ডা (৯২) নামে ছয় জনের মৃত্যু হয়েছে। ফুলবন্তি নাইক-এর মৃত্যুর কোনও উল্লেখ কিন্তু হাসপাতালের খাতায় নেই। বাগানের হেল্থ অ্যাসিস্ট্যান্ট সচিন নার্জিনারি বলেন, “অপুষ্টি অন্যতম কারণ বলে শুনেছি। তবে মৃত্যুর পর চিকিৎসক পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করে কারণ লিখেছেন। এখানে সামান্য কিছু ওষুধ রয়েছে। তা দিয়ে জ্বর, সর্দি, পেটের অসুখ চিকিসা সারতে পারে। গুরুতর কিছু হলে মুশকিল।” শ্রমিক অসন্তোষের কারণ দেখিয়ে ২৯ জুলাই বীরপাড়া থেকে ৭ কিমি দূরে দলমোড় বাগান ছেড়ে চলে যান কর্তৃপক্ষ। বাগানের ১২২৩ শ্রমিক পরিবার বিপাকে পড়ে। চার দফায় মালিকের সঙ্গে শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের বৈঠকের আয়োজন হলেও মালিকরা বেঁকে বসায় বাগান চালু হয়নি। বাগান মালিক সংগঠন ডুয়ার্স ব্রাঞ্চ অব ইন্ডিয়ান টি অ্যাসোসিয়েশনের সচিব প্রবীর ভট্টাচার্য বলেন, “কোনও ঝামেলা করা হবে না বলে শ্রমিক সংগঠনগুলিকে লিখিত দিলে কর্তৃপক্ষ বাগান খুলতে আগ্রহী বলে শুনেছি। বাগানে ওষুধ ও জল দেওয়া হচ্ছে। বিনা চিকিৎসায়, অপুষ্টিজনিত কারণে মৃত্যুর খবর আমার কাছে নেই।” শিলিগুড়ির একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মুখপাত্র অনিমেষ বসু দীর্ঘ দিন তরাই-ডুয়ার্সের বন্ধ চা বাগানের শ্রমিকদের সহায়তা করছেন। তিনি বলেন, ‘‘যে সব চা বাগান দীর্ঘ দিন বন্ধ, সেখানে শ্রমিকদের গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করার জন্য একটা সুষ্ঠু পরিকল্পনা এবং নিয়মিত নজরদারির প্রয়োজনের কথা আমরা বহু দিন ধরেই বলে আসছি। কিন্তু তা না করে কোথাও একশো দিনের কাজ, কোথাও অন্ত্যোদয়ের চাল অনিয়মিত ভাবে দেওয়া হচ্ছে। ফলে অপুষ্টি, অনাহার কমছে না।’’ |