বনেই ভাল আছেন গেছো-বাবা
প্যাঁচা নন, তবু তিনি কোটরে থাকেন! তাঁর নামে সরকারি পাকা ঘর বরাদ্দ হয়েছে। তিনি সেখানে থাকেন না। পাকা বাড়িতে পাখির কলকাকলি কোথায়? কোটরকে আশ্রয় করেছেন তিনি। ভোর হলে পাখিরা গাছের ডালে বসে গান শোনায়। সন্ধ্যায় জল খেতে যাওয়ার পথে হাতিরা শুঁড় উঁচিয়ে যেন খোঁজ নেয়, ‘গেছো বাবা ভাল তো?’ ‘গেছো বাবা’ মানে দিলীপ লোহার এতে ভারী সুখী। কুড়ি বছর ধরে গাছের এক কোটরে বাস করছেন তিনি। গাছগাছালি, পাখপাখালি, জন্তু-জানোয়ার নিয়েই তাঁর পরিবার। কালচিনি থানার পানা জঙ্গলের ধারে সব মিলিয়ে ‘দিব্য’ আছেন ‘গেছো বাবা’। পানার জঙ্গলের অশ্বত্থ আর ময়না গাছের কোটর মানে হেলাফেলা ব্যাপার নয়। তিনটি কোটরে যাতায়াত তাঁর। ভোরে উঠে পাখির গান শোনা। বিস্তীর্ণ সবুজ বনের দৃশ্য দেখা।
আলিপুরদুয়ারের মহকুমা শাসক অমলকান্তি রায় খুব ভাল মতো চেনেন গেছো বাবাকে। কথা বলার সময়ে অমলকান্তির চোখেমুখে যেন বিস্ময় খেলা করে। তিনি বলতে থাকেন, “জানেন, লোকটা ভারী অদ্ভুত। বছর দুয়েক আগে ৩০ হাজার টাকায় পাকা ঘর তৈরি করে দেওয়া হল। সরকারি খরচে। কে কার কথা শোনে! উনি যেন প্রকৃতির সঙ্গে মিশে। মানুষের সঙ্গে থাকতে ভাল লাগে না। তবুও নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে আমরা এখন ভাবি।” কালচিনির চুয়াপাড়া চা বাগানের শ্রমিক ছিলেন ষাটোর্ধ্ব গেছো বাবা। ছোট বেলা থেকে বন-মুখো।
বিয়ে থা করেননি। বাগানে কাজ করে চার ভাই-এর সংসার ঠিকঠাক চলছিল। ভাইদের বুকে আগলে মানুষ করলেও এক সময় অসুখে পড়েন তিনি। বাড়ির কেউ অসুস্থ দাদার সেবা শুশ্রূষা করতেন না বলে অভিমানে দুর্বল শরীর নিয়ে বক্সার পানা জঙ্গলের গভীরে একটি অশ্বত্থ গাছের কোটরে আশ্রয় নেন। দিন সাতেক না খেয়ে ছিলেন তিনি। সে সময় জঙ্গলের ভেতরে জ্বালানি সংগ্রহ করতে যাওয়া কয়েকজন গ্রামবাসী তাঁকে ওই অবস্থায় দেখে গ্রামে নিয়ে যান। একটি পোড়ো বাড়িতে আশ্রয় দেন। ভুত বাড়ি বলে গ্রামের লোকজন ওই বাড়ির কাছে রাতে ঘেঁষতেন না। তবে সেখানে বছর খানেক থাকার পরে পানা বস্তি থেকে কিছু দূরে জঙ্গলের একটি ময়না গাছের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা প্রাচীন একটি অশ্বত্থ গাছের কোটরই হয় তাঁর ঠিকানা। দুটি গাছের নামও দিয়েছেন তিনি। সত্যম ও প্রীতম।
অনেক সময়ে গাছের সঙ্গে বিড়বিড় করে কথাও বলেন তিনি। বস্তিতে কেউ ভালবেসে কিছু খেতে দিলে খান। না দিলে নদীর জল খেয়ে রাতকাবার করে দেন। গাছের চারিদিক সব সময় ঝেড়ে পরিষ্কার করে রাখেন। কোটরের নীচে গাদা ফুলের চারা বুনেছেন। জংলি ফুলের সঙ্গে গাঁদাফুল ফুটছে সমান তালে। গেছো বাবার বাড়ি নেই বলে বছর দুয়েক আগে জেলা প্রশাসনের পক্ষে পানা বস্তির এক খণ্ড জমিতে পাকা ঘর তৈরি করে দেয় জেলা প্রশাসন। সে ঘরে তিনি যাতে থাকেন সে জন্য নানা ভাবে বোঝানো হয় গেছো বাবাকে। ঘরের ভেতর একটি খাটিয়াও বরাদ্দ করা হয়েছে। তবে তাঁর তা ভাল লাগে না। দিলীপ লোহারের কথায়, “ঘরটিতে দানের জামা রেখে দিই। ছোট্ট কোটরে ওই সব রাখার জায়গা তেমন নেই। মাঝে মধ্যে গিয়ে ঘুরে আসি। মানুষের সঙ্গে থাকতে আমার ভাল লাগে না। এটা কেউ বুঝতে চায় না।” ঘটনা হল, মানুষের সাহায্যও নিতে চান না তিনি। তাই আরএসপির জেলা পরিষদের সদস্য রামকুমার লামা একটি দোকান থেকে ফি মাসে আনাজপাতি দিতে চাইলেও তা অবহেলায় ফিরিয়ে দেন তিনি। রামকুমারবাবুর কথায়, “এমন মানুষও হয়? আমি মাসে খাবারের ব্যবস্থা করেছি শুনে চটে যান। সে কী চোটপাট!” পানাবস্তির অনুপ ছেত্রীর কথায়, “ওর ঘরের জন্য জমি দিয়েছি। সেখানে থাকে না। তবে মাঝে মধ্যে এসে ঘর পরিষ্কার করে । কেউ খেতে দিলে খান। না দিলে খান না। মানুষের ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলতে চান।” গেছোবাবা বলেন, “কত কী যে আছে অরণ্যে, ভাবা যায় না। মানুষের দুনিয়া ফালতু,সাজানো ব্যাপার।”

ছবি: রাজকুমার মোদক।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.