দলীয় লাইনের উল্টো পথে হেঁটে মুসলিম পরিচিতি সত্তার পক্ষে সওয়াল করলেন সিপিএমের রাজ্য কমিটির সদস্য মইনুল হাসান।
দলের যুব সংগঠনের শারদ সংখ্যায় মইনুল লিখেছেন, ভারত ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হওয়া সত্ত্বেও মুসলিমরা চাকরি থেকে আরম্ভ করে বিচারব্যবস্থা, সমাজজীবনের সর্বত্র ‘বঞ্চিত’ হচ্ছেন। ৩৪ বছরের বাম জমানায় এ রাজ্যে কী ভাবে মুসলিমদের স্বার্থ উপেক্ষা করা হয়েছে, তা-ও উল্লেখ করেছেন তিনি।
কী রকম? মইনুল লিখেছেন, বিএসএফে চাকরির পরীক্ষায় সামান্য অজুহাতে মুসলিম যুবককে বাদ দেওয়া হয়েছে। মুসলিমদের ভাবাবেগকে উপেক্ষা করে কলকাতা, কোচবিহারে কবরস্থানের জমি নগরায়ন বা আবাসনের কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রাক্তন সংখ্যালঘু উন্নয়ন মন্ত্রী আব্দুস সাত্তার মইনুলকে সমর্থন করে বলেন, “মইনুলদা যা বলেছেন, ঠিকই বলেছেন। মুসলিমদের সমস্যাকে যে ভাবে দেখা উচিত ছিল, অনেক সময়েই তা হয়নি।” পরিচিতি সত্তার রাজনীতি সম্পর্কে যখন দলের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট বারবার সতর্ক হতে বলছেন, তখন মইনুলের লেখায় এ সব কথা কেন? মইনুলের কথায়, “মনের যন্ত্রণা মনে চেপে না রেখে যাতে মুসলিম সদস্যরা দলীয় মঞ্চে খোলামেলা আলোচনা করেন, সেটাই লক্ষ্য।” মইনুলের বক্তব্য, বহু মুসলিম কমরেড তাঁদের সমস্যা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেন। কিন্তু দলীয় মঞ্চে তাঁরা সরব হন না। কেন? “নানা ভাবে উপেক্ষার কারণে মুসলিমদের একাংশ সিপিএম থেকে ক্রমেই সরে যাচ্ছে। দলে মুসলিম সদস্য সংখ্যা কমছে।”
নিজের মুসলিম পরিচিতি সত্তাকে তুলে ধরতে ইতিমধ্যেই মক্কায় হজ করতে গিয়েছেন রাজ্য কমিটির সদস্য রেজ্জাক মোল্লা। রেজ্জাকও মনে করেন, বাম আমলে মুসলিমদের উপেক্ষা করা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারে থাকার সময়ে এ কথা না বলে এখন বলছেন কেন? এর পিছনে কি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কাজ করছে? মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে মুসলিমদের বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে গিয়ে তাঁদের কাছে টানার চেষ্টা করছেন, তা প্রতিরোধ করতেই কি মইনুল-রেজ্জাক-সাত্তাররা মুসলিম সত্তার কথা তুলে ধরতে চান? সিপিএমের মুসলিম নেতারা তা মানতে নারাজ। তাঁদের বক্তব্য, মমতা মুসলিম-প্রীতি দেখালেও, তাদের উন্নয়নের জন্য কিছু করছেন না। মুসলিম সত্তা নিয়ে মইনুল এখন এতটাই সংবেদনশীল যে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, পাঠ্যপুস্তকে ‘গোপাল অতি সুবোধ বালক’-এর সঙ্গে ‘করিম ভাল ফুটবল খেলে’ কেন থাকে না? তিনি অশোক, আওরঙ্গজেবের মতো বিভিন্ন ঐতিহাসিক চরিত্র নিয়েও মইনুল লিখেছেন, “ইতিহাসের এই সহজ রাস্তা বেয়েই কিশোরদের মনে চেপে বসে বিভেদের বিশ্বাস। মুসলিম মানেই অত্যাচারী আর হিন্দু দানশীল।”
সাচার কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশের পরে মুসলিমদের মধ্যে সংগঠন বাড়াতে সংখ্যালঘু কমিটি তৈরি করে সিপিএম। কিন্তু তার পরেও দলে মুসলিম সদস্য বাড়ানো যায়নি। বরং পশ্চিমবঙ্গ, কেরল থেকে আরম্ভ করে অন্ধ্রপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়, ঝাড়খণ্ড, হিমাচলপ্রদেশ, গুজরাত-সহ ১৫টি রাজ্যে গত কয়েক বছরে দলে মুসলিম সদস্য ক্রমেই কমছে। এমনকী এ রাজ্যের উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, বীরভূম, বর্ধমানের মতো জেলাতেও কমেছে মুসলিম সদস্য। এমতাবস্থায় সিপিএমের রাজ্য বা কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব মইনুলের লেখা নিয়ে এখনই কোনও মন্তব্যে যেতে রাজি নন। ‘লেখাটি পড়িনি’ বলে অনেক নেতাই মন্তব্য থেকে বিরত থেকেছেন। কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নীলোৎপল বসু বলেন, “পরিচিতি সত্তা নিয়ে আমরা সঙ্কীর্ণ বিভেদের রাজনীতির বিরুদ্ধে। কিন্তু যদি এ নিয়ে যুক্তিসঙ্গত দাবি থাকে, তা হলে তার সমাধান করতে হবে। এটাই আমাদের নীতি।” |