দেবজিৎ ভট্টাচার্য • কলকাতা |
সরকার ভাড়া বাড়াতে না-দেওয়ায় ধর্মঘট করেছিলেন বাস-মালিকেরা। ভাড়াবৃদ্ধির দাবিতে এ বার একই পথে হাঁটতে চলেছেন রাজ্যের হিমঘর-মালিকেরাও। সেই সঙ্গে তাঁদের দাবি: হিমঘরের ভাড়া নিয়ন্ত্রণ-নির্ধারণের ভার সরকার নিজের হাতে না-রেখে কোনও স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সংস্থার হাতে ছাড়ুক। টেলিফোন-বিদ্যুৎ-বিমার ক্ষেত্রে যেমনটি রয়েছে।
মালিকেরা জানিয়েছেন, হিমঘর-ভাড়ার পুনর্বিন্যাসের লক্ষ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের গড়া কমিটিও ভাড়াবৃদ্ধির পক্ষে রায় দিয়েছে। তবু রাজ্য এখনই হিমঘরের ভাড়া বাড়াতে নারাজ। আর এরই প্রতিবাদে চলতি মাসে এক দিন হিমঘরে ধর্মঘট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাঁরা। প্রতিবাদের অঙ্গ হিসেবে এ বছরে আলু মজুতের সময়সীমাও বাড়ানো হচ্ছে না। মালিকদের বক্তব্য: তিন বছরে মজুরি ও ডিজেল-বিদ্যুতের দাম যে হারে বেড়েছে, তাতে অবিলম্বে হিমঘরের ভাড়া না-বাড়ালে টিকে থাকা সম্ভব নয়। হাল এমনই যে, ব্যাঙ্ক-ঋণ শুধতে না-পেরে সম্প্রতি বর্ধমান ও পশ্চিম মেদিনীপুরে দশটি হিমঘর বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এমনটা চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে আরও হিমঘরে তালা ঝুলে যাবে বলে মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখে জানিয়েছে মালিক সংগঠন।
হিমঘর-ভাড়ায় সরকারি রাশ প্রত্যাহারের দাবিও উঠেছে। মালিকেরা চাইছেন, সরাসরি সরকারি নিয়ন্ত্রণের বদলে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সংস্থা গড়ে তার হাতে হিমঘরের ভাড়া সংক্রান্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার ছাড়া হোক। মালিকপক্ষ বলছে, পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া কোথাও রাজ্য সরকার হিমঘরের ভাড়া নিয়ন্ত্রণ করে না, সেখানে হিমঘর-মালিকেরাই ফি বছর নতুন ভাড়ার হার স্থির করে প্রশাসনকে জানায়। পশ্চিমবঙ্গ প্রশাসনের একাধিক কর্তা অবশ্য ‘চাষির স্বার্থহানি’র আশঙ্কার যুক্তিতে মালিকদের হাতে একতরফা ভাড়া নির্ধারণের ক্ষমতাদানের প্রশ্ন উড়িয়ে দিচ্ছেন। রাজ্যের হিমঘর-মালিক সংগঠন ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন’-এর অন্যতম মুখপাত্র পতিতপাবন দে-ও বলছেন, “আমরাও অন্য রাজ্যের মতো ব্যবস্থা এখানে চাইছি না। আমরা শুধু চাইছি, ফোন-বিদ্যুতের মতো হিমঘরের মাসুল নির্ধারণেও সরকার-নিরপেক্ষ নিয়ন্ত্রক সংস্থা তৈরি হোক।”
প্রস্তাবটি কার্যকর হলে যেমন ভাড়া সংক্রান্ত জটিলতা কাটবে, তেমন রাজনৈতিক হস্তক্ষেপও বন্ধ হবে বলে পতিতপাবনবাবুর দাবি। ওঁদের আরও অভিযোগ, সরকারি নিয়ন্ত্রণের কারণে কেন্দ্রীয় অনুদান থেকেও তাঁরা বঞ্চিত হচ্ছেন। অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রামপদ পালের যুক্তি, “পশ্চিমবঙ্গে অধিকাংশ হিমঘর ২৫-৩০ বছরের পুরনো। সেকেলে বাতানুকূল ব্যবস্থায় বিদ্যুৎ লাগে প্রচুর। জাতীয় উদ্যান পর্ষদ হিমঘর সংস্কারে অনুদান দেয়। শর্ত ব্যবসায় সরকারি হস্তক্ষেপ থাকবে না। তাই আমরা সুযোগটা পাচ্ছি না।” রাজ্যের কী বক্তব্য?
রাজ্যের কৃষিজ বিপণন দফতরের মন্ত্রী অরূপ রায় অভিযোগটি মানতে রাজি নন। “জাতীয় উদ্যান পর্ষদের অনুদান পেতে আমি কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী শরদ পওয়ারকে চিঠি লিখেছি। কিন্তু হিমঘরে সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকলে টাকা মিলবে না, এমন শর্ত আমার জানা নেই।” বলেন তিনি। হিমঘর-ভাড়া নির্ধারণে নিরপেক্ষ সংস্থা গঠনের দাবি প্রসঙ্গে মন্ত্রী অবশ্য বিস্তারিত মন্তব্যে যেতে চাননি। শুধু বলেন, “সমস্ত বিষয়টিই আমাদের ভাবনাচিন্তার মধ্যে আছে।”
হিমঘরে মার্চ থেকে নভেম্বর পর্যন্ত মূলত আলু রাখা হয়। চাষিরা এই ন’মাসের জন্য হিমঘর ভাড়া নেন। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ভাড়া শেষ বেড়েছিল ২০১০-এ, কুইন্টালপিছু ১৪ টাকা হারে। সেই দফায় দক্ষিণবঙ্গে বর্ধিত ভাড়া দাঁড়ায় প্রতি কুইন্টালে ১০১ টাকা, উত্তরবঙ্গে ১০৯ টাকা। ওয়েস্ট বেঙ্গল কোল্ড চেন অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ ওনার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সত্য মুখোপাধ্যায় বলেন, “অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় এখানে ভাড়া অনেক কম। অথচ ডিজেল, বিদ্যুৎ, সবের দাম বেড়েছে। বেড়েছে কর্মী-মজুরি। সব মিলিয়ে খরচ বেড়েছে ৪৬%। ভাড়া বাড়েনি এক টাকাও। আমরা চাইছি, ভাড়া হোক কুইন্টালে অন্তত ১৩০ টাকা।” অন্য দিকে রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, “হিমঘর-ভাড়ার পুনর্বিন্যাস ঘটাতে কৃষিজ বিপণন দফতরের অধিকর্তার নেতৃত্বে ১৩ জনের যে কমিটি হয়েছে, প্রতি বছর ভাড়া বৃদ্ধির সুপারিশ তারাই করে।”
কিন্তু বার বার চিঠি দিয়েও এই দু’বছরে রাজ্য সরকারের তরফে ভাড়াবৃদ্ধির উদ্যোগ চোখে না-পড়ায় প্রতিবাদের পথে হাঁটতে চাইছেন মালিকেরা। ধর্মঘটের সিদ্ধান্তের পাশাপাশি তাঁরা ঠিক করেছেন, গত বছরের মতো এ বার হিমঘরে আলু রাখার সময়সীমা বাড়ানো হবে না। রামপদবাবুর কথায়, “গত বার ফলন ভাল হওয়ায় নভেম্বরের পরেও বহু হিমঘরে পাহাড়প্রমাণ আলু রয়ে গিয়েছিল। অভাবী বিক্রি ঠেকাতে সরকার ডিসেম্বর পর্যন্ত আলু মজুত রাখার অনুরোধ করে। বলা হয়েছিল, বাড়তি ভাড়া রাজ্যই মিটিয়ে দেবে। সে টাকাও এখনও পাইনি।” |